Advertisement
০৫ মে ২০২৪

‘আত্মগ্লানির কোনও মানে নেই’

এ এক বিরল ঘটনা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিলেন স্বয়ং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়! ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবিতে দু’জনকে দেখা যাবে বাবা-ছেলের ভূমিকায়। তার আগে এক অভিনব আড্ডার সাক্ষী আনন্দ প্লাসএ এক বিরল ঘটনা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিলেন স্বয়ং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়! ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবিতে দু’জনকে দেখা যাবে বাবা-ছেলের ভূমিকায়। তার আগে এক অভিনব আড্ডার সাক্ষী আনন্দ প্লাস

ছবি: সুদীপ্ত চন্দ

ছবি: সুদীপ্ত চন্দ

স্বর্ণাভ দেব
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:০৪
Share: Save:

প্রসেনজিৎ: তুমি এত ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছ। মোটিভেশনটা কী?

সৌমিত্র: যদি চরিত্রে বিশেষত্ব থাকে, তা হলে এগিয়ে যাই। এমন ছবিও করেছি, যেখানে কিছুই নেই। তবে অভিনয় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। থেমে যাওয়া মানে এক রকম মৃত্যু। ভিন্ন চরিত্রের খোঁজ চলতেই থাকে। ছবির কনটেন্ট, মেকিংয়ের দিকটাও দেখি।

প্রসেনজিৎ: এত দিন ধরে এই প্রসেসটার মধ্য দিয়ে তুমি বাঙালিদের আইকন হয়ে উঠেছ। নিজের সঙ্গে চলতে থাকা সংঘর্ষগুলো সামলাও কী ভাবে?

সৌমিত্র: সব সময়ে কি আর সামলাতে পারি? নির্ভর করতে হয় অন্য কিছুর উপর। কখনও পরিস্থিতি সাহায্য করে। বিশ্বাস করি, কাজটা ভাল ভাবে করতে পারলে কোনও কিছু আটকায় না। মানুষের উপর অভিমানও হয়। মনে হয়, আমার দেশের মানুষই আমাকে বুঝল না! তার পর ভাবি, মানুষের সম্মান, ভালবাসাতেই তো আমি এখানে পৌঁছেছি।

প্রসেনজিৎ: জাতীয় পুরস্কার নিতে উঠেছিেল যখন, অডিটোরিয়ামের সকলে উঠে দাঁড়িয়েছিল। ক’জনের ভাগ্যে এ রকমটা জোটে!

সৌমিত্র: সেটাই অনেকটা দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়।

প্রসেনজিৎ: সিনেমা, সাহিত্যচর্চা, আবৃত্তি, পেন্টিং, ছবির প্রোমোশন... এত কিছু কী ভাবে সামলাও?

সৌমিত্র: একটু শক্ত বটেই। আমি তো রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ নই। কিন্তু জীবনে কিছু করার দায়িত্ব আছে। পেন্টিং আমার অবসরযাপন। তা নিয়ে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু অভিনয়, কবিতা নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার দায় থাকে। অভিনয়ের শুরু ছোটবেলায়। আর কবিতা কৈশোরের রোম্যান্টিক চেতনা থেকে। প্রেমেও পড়েছিলাম তখন। আমার চ্যালেঞ্জ, কেউ যখন অবসরে আমার অভিনয় দেখবেন, সেটা যেন তাঁকে মানসিক ভাবে স্বস্তি দেয়। এ ক্ষেত্রে আমার আইডল চার্লি চ্যাপলিন।

প্রসেনজিৎ: যত বারই ওঁর কাজ দেখো, মনে হবে একদম ফ্রেশ!

সৌমিত্র: এগজ্যাক্টলি। দেখলেই মনে হয়, জীবনটা যদি এমন হত! সেখানে আমি পৌঁছতে পারব কি না, জানি না। কিন্তু লক্ষ্যটা উঁচু রাখি।

আনন্দ প্লাস: রোজ পারফর্ম করার চাপে ক্লান্ত লাগে না?

সৌমিত্র: এখন শরীর এতটা ধকল নিতে পারে না। একঘেয়ে কাজে ক্লান্তিও আসে। কিন্তু আমার মোটিভেশন হল পরিবার। সারা জীবন পাশে থেকেছে। তাই আমার কর্তব্য পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। প়ঞ্চাশের গণ্ডি পেরিয়ে মনে হত, জীবনের সার্থকতা কী? খ্যাতি ছেড়ে অ্যালবার্ট সোয়াইটজার আফ্রিকায় মানুষের সেবায় জীবন কাটালেন। সেখানে পৌঁছতেও পারব না। পরে বুঝলাম, আত্মগ্লানির কোনও মানে নেই। আমার কর্তব্য দর্শকের মুখে হাসি ফোটানো।

প্রসেনজিৎ: কত ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছ! হিংসে হয়। সৌমিত্র: আমি বৈচিত্রের ভক্ত। একঘেয়েমি হলে চলবে না। এই হুঁশটা ছোট থেকে তৈরি হয়েছিল।

প্রসেনজিৎ: এটা আমাকেও তাড়া করে বেড়ায়।

সৌমিত্র: আমার চেয়েও সুন্দর নায়ক বাংলা সিনেমা পেয়েছে। কিন্তু মাটির এত কাছাকাছি থাকা মানুষ হয়তো মেলেনি। শুনেছি, তপন সিংহ একবার সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন, ‘যাক, এত দিনে একজনকে পাওয়া গেল!’

প্রসেনজিৎ: যাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া যায়!

সৌমিত্র: ঠিকই। সময়ই আমাকে তৈরি হতে সাহায্য করেছে।

প্রসেনজিৎ: ‘অটোগ্রাফ’-এর আগে আমারও একই হাল। সাকসেসফুল কেরিয়ার হলেও অন্য কিছু খুঁজছিলাম। তুমি যদি অন্য কিছু না খুঁজতে, তা হলে সময় তোমাকে স্বীকৃতি দিত না।

আনন্দ প্লাস: এত স্বীকৃতি পেয়েছেন। এখনও কীসের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেছেন?

সৌমিত্র: ওগুলোয় মেতে উঠলে এগোনোর পথ থেমে যাবে। স্বীকৃতি অনুপ্রেরণা দিতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনাটাই আসল।

প্রসেনজিৎ: তোমার অভিনয়ের ধরন বাংলা ছবিতে বিরল। ‘ময়ুরাক্ষী’তে আবার দেখলাম। কী ভাবে অভিনয়ের ধারা বারবার বদলে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রেখেছ?

সৌমিত্র: অভিনয় তো ব্যঞ্জনাধর্মী শিল্প। তোমার কর্তব্য, তাতে মনোযোগ দিয়ে জীবন ঢেলে নতুন কিছু নির্মাণ করা।

প্রসেনজিৎ: ‘ময়ুরাক্ষী’তে বাবা-ছেলের গল্প রয়েছে। বাস্তবে তোমার বাবা কেমন ছিলেন?

সৌমিত্র: বাবা নিজেও অভিনয়, আবৃত্তি করতেন। মায়ের ভালবাসা সাহিত্য। দু’জনের গুণগুলো আমার মধ্যে এসেছে। পরিবার আমাকে বাধা দেয়নি। রিটায়ারমেন্টের বছর দুয়েক আগে বাবা বলেছিলেন, অভিনয় অনিশ্চিত পেশা। অনেকে খেতে পায় না। জবাবে দাদা বলেছিল, ‘তোমার অবসরের আগেই আমি চাকরি পেয়ে যাব। ভেবো না।’ এমন উৎসাহ বিরল!

আনন্দ প্লাস: উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা থাকলেও আপনাদের মধ্যে বন্ধুত্বও ছিল। সে রকম সম্পর্ক কি এখন পেশাদারিত্বের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে?

সৌমিত্র: এখনকার সবাইকে আমি খুব ভাল চিনি না। তবে এটা বিশ্বাস করতে চাই না।

প্রসেনজিৎ: তখন তো আনন্দ প্লাস ছিল না (হেসে)! তোমাদের ঝগড়াটাও কখনও তাই বাইরে আসত না!

সৌমিত্র: একদম। আমাদের মধ্যে কম ঝগড়া হয়েছে!

প্রসেনজিৎ: ইন্ডাস্ট্রি তো পরিবারের মতো। বন্ধুত্ব, ঝগড়া সবই থাকে।

সৌমিত্র: উত্তমদা আমার ভগ্নীপতির বন্ধু ছিলেন। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ইন্ডাস্ট্রিতে আসার আগে। প্রতি শনিবার ওঁদের আড্ডা বসত। আমিও যেতাম। উত্তমদা তখন মালকোচা দিয়ে ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি পড়ত। এমন গ্ল্যামারাস মানুষ খুব একটা দেখা যায় না।

আনন্দ প্লাস: কাকে নিজের উত্তরসূরি মনে করেন?

সৌমিত্র: যাকে উত্তরসূরি ভাবছিলাম, সে তো এই মুহূর্তে নকড আউট অফ অ্যাকশন। সে আমার নাতি রণদীপ।

আনন্দ প্লাস: আশি পেরিয়ে নিজের জীবনকে কী ভাবে দেখেন?

সৌমিত্র: কথাটা হয়তো হতাশার মতো শোনাবে। তবে জীবনের কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমি পৃথিবীতে রয়েছি। সেটার সার্থকতাও কি আদৌ বুঝতে পেরেছি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE