Advertisement
E-Paper

প্রাক্তনের মধ্যেও ‘নতুন’ পাওয়া যায়

যেমন লেটার উড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা। লিখছেন শ্রীজাতপুরনো চাল যে আজও ভাতে বাড়ে, ‘প্রাক্তন’ তা প্রমাণ করে ছাড়ল। যে-জুটি এক সময়কার মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শকের আইডল, যে-জুটি দীর্ঘদিন আড়ালে থাকায় দর্শক এক রকম ধরেই নিয়েছিলেন যে আর তাঁদের ম্যাজিক পর্দায় দেখা যাবে না, সেই জুটিকে ফিরিয়ে আনার মহাযজ্ঞ যদি হয়, তাহলে তা ‘প্রাক্তন’য়ের মতো করেই হওয়া উচিত।

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৬ ০০:০০

পুরনো চাল যে আজও ভাতে বাড়ে, ‘প্রাক্তন’ তা প্রমাণ করে ছাড়ল। যে-জুটি এক সময়কার মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শকের আইডল, যে-জুটি দীর্ঘদিন আড়ালে থাকায় দর্শক এক রকম ধরেই নিয়েছিলেন যে আর তাঁদের ম্যাজিক পর্দায় দেখা যাবে না, সেই জুটিকে ফিরিয়ে আনার মহাযজ্ঞ যদি হয়, তাহলে তা ‘প্রাক্তন’য়ের মতো করেই হওয়া উচিত। বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে না যে, সৌরভ যেভাবে ক্রিজে ফিরেছিলেন, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণাও প্রায় তেমনই জয়জয়কার নিয়ে ফিরলেন। আর সেই জমজমাট প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে ফেলার জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। এই দুজনের যুগলে ফেরা নিয়ে শহরে গুঞ্জন শুরু হওয়া থেকে হলের বাইরে ‘হাউসফুল’ বোর্ড টাঙানো অব্দি যে-দীর্ঘ সফর, নন্দিতা-শিবপ্রসাদ নিপুণ পরিকল্পনায় সেটি বুনেছেন।

আরেক দিকে অবাক করলেন তাঁরাও, যাঁদের ফিরে আসা নিয়ে এত হইচই। রসায়ন যে কী দুর্মূল্য বস্তু, দেখিয়ে দিলেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একই ইন্ডাস্ট্রিতে থেকেও একসঙ্গে অভিনয় করেননি এঁরা, ‘প্রাক্তন’ দেখে সে কথা মনে থাকে না। মনে হয় বছরে গোটা বারো ছবি করে থাকেন নির্ঘাত, এমনই তাঁদের সাবলীলতা! অবশ্য সেটা আছে বলেই এত দিন শিখরে টিকে আছেন তাঁরা। গোড়ায় প্রেম, মাঝে ঝগড়া আর শেষে পুনর্মিলন, যা কিনা আরেক বিদায়েরই আরম্ভ, এই তিন পর্যায়ে তিন রকমের মানুষের বোঝাপড়া ফুটিয়ে তোলা দুষ্কর বইকী। প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা সেই দুরূহ পরীক্ষায় লেটার উড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। এই না হলে কামব্যাক?

কাহিনি আমাদের বহু দিনের চেনা, সেখানে নতুনত্ব বা নিরীক্ষার চেষ্টা করেননি দুই পরিচালক। নিশ্চয়ই তাঁদের জোরদার বিশ্বাস ছিল যে, নায়ক-নায়িকার কামব্যাক-এর টানই এখানে মুখ্য হয়ে উঠবে, আর তা হয়েওছে। এই মুহূর্তে অমিতাভ-রেখা জুটি ফিরে এলে যেমন কাহিনি আর মুখ্য থাকবে না সাধারণ দর্শকের কাছে, ঠিক তেমনই। নইলে বোধহয় গল্পটাকে আরেকটু তরতাজা চেহারা দিতে পারতেন তাঁরা। বর-বউয়ের মধ্যে অহং-এর লড়াই আমরা আগেও তো দেখেছি। ‘সাত পাকে বাঁধা’-তেই কী চমৎকার ভাবে ছিল সেসব। কিন্তু আজ এই ২০১৬-তেও শিক্ষিত শহুরে পুরুষ কি সেই বস্তাপচা অহং পুষে রাখেন?

ধরে নিই রাখেন কেউ কেউ। এখনও মনে করেন তাঁর বউ-এর মন থেকে ফোন, সবই তাঁর ‘প্রপার্টি’। কিন্তু সে তো এক গভীর ও প্রাচীন মানসিক সমস্যা। সেই ‘ক্লিশে’ থেকে একজন বেরোতে পারলেন না বলে আরেক জনকে সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হল। এও নয় বাস্তব বলে মানলাম। যদিও সব কিছু কেবলমাত্র বাস্তব বলেই মেনে নেওয়া চলে না, তবু। কিন্তু যখন দেখি কিছু বছর পর সেই মানুষটিই দ্বিতীয়বার বিয়ে করে পাল্টে গিয়েছেন, অবাক লাগে। সন্দেহ হয়, সত্যি পাল্টেছেন তো? নাকি সংসারের ছকটাই পাল্টে গিয়েছে? পরে বুঝি, সেটাই কারণ।

দ্বিতীয় বউ স্বাধীনচেতা নন, মেয়ে জন্মাবার পর বাইরে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছেন, তাঁর নিজস্ব সামাজিক সাফল্য বা চাহিদা নেই, তিনি টেলি সিরিয়াল আর রান্নাবান্না আর মেয়েকে মানুষ করা নিয়ে মেতে থাকতেই খুশি। গোটা মাসে কেবল একদিন বরকে নিজের মতো কাছে পেলেই হল। এখন এই যদি তাঁর মানসিকতা হয়, তাহলে পুরুষ সঙ্গীটির নিজেকে বদলাবার সুযোগ বা প্রয়োজন, কোনওটাই আসে না, তাই না? তার মানে কি তাহলে এই দাঁড়ায় যে, সামাজিক ভাবে সফল দুজন নারী-পুরুষ আজও সহাবস্থানে সক্ষম নন? গুছিয়ে সংসার করতে হলে পুরুষ অহং-এর মিথ্যে চূড়ার সামনে নারীকে মাথা নুইয়ে হাসিমুখে থাকতে হবে? তবেই সম্পর্ক টিকে থাকবে? এই কি ‘প্রাক্তন’-এর বার্তা? নিশ্চয়ই নয়? কারণ এমন ধারণা ২০১৬-তে আশা করব না।

নন্দিতা-শিবপ্রসাদও নিঃসন্দেহে এমনটা বিশ্বাস করেন না, নইলে ‘ইজাজত’-এর শশী কপূরের মতো শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় হাওড়ায় ঢুকতেন না। তিনি ঋতুপর্ণার দ্বিতীয় বর, যিনি বউ-এর কথামতো ট্রেন সফরে একবারও ফোন বা এসএমএস করেননি। অর্থাৎ, সঙ্গিনীর স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত ‘স্পেস’-এ বিশ্বাসী একজন পুরুষ। এমন একজনকেই তো খুঁজেছিলেন সুদীপা, যেমন মানুষকে তিনি তাঁর উজান-য়ের মধ্যে দেখতে পাননি কোনও দিন। তাই যদি হয়, তবে উজানের দ্বিতীয় বউ, এতক্ষণের সহযাত্রী মালিনীর এই কথাটি কেন সুদীপার এত মনে ধরে যে, মানিয়ে নেওয়া বা আপস করা মানে হেরে যাওয়া নয়, আসলে জিতে যাওয়া? কেন সুদীপাকে এমন অবস্থানে এসে দাঁড়াতে হয় যেখানে নিজের অনাপসি, স্বাধীন চেহারাটাকে তিনি নিজেই ব্যর্থ বলে মেনে নেন? তাঁর নিজেকে একক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইটা কি তাহলে সেই মুহূর্তেই ছোট হয়ে যায় না? নিজেরই আয়নায়? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি পাইনি।

যেমন পাইনি বিশ্বনাথ ও মানালির মতো সদ্যবিবাহিত দম্পতির যৌন-কৌতুক ব্যবহারের কারণ। অপরাজিতা আঢ্য একজন দক্ষ অভিনেতা, বহু ছবিতে তা প্রমাণিত। এখানে তাঁকে একটু চড়া সুরে বাঁধা হল কি ঋতুপর্ণার শিক্ষা ও সূক্ষ্মতাকে বেশি করে ফুটিয়ে তোলার জন্য? জানি না।

তবে ভারী ভাল লেগেছে ট্রেনের কামরায় এত দিন পর বিচ্ছিন্ন দুজন মানুষের দেখা হওয়ার মুহূর্তটি। যে-দৃশ্যের জন্য দর্শক দম চেপে রেখে অপেক্ষা করছেন, সেখানে এক ইঞ্চি বাড়তি নাটকীয়তা তো নেইই, এমনকী অন্যান্য অনেক কিছু দেখাবার প্রলোভনকে দূরে ঠেলে দুজনের মুখোমুখি হওয়ার পটভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গলায় রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’-র অনবদ্য উচ্চারণ যেভাবে ব্যবহৃত, তা প্রশংসনীয়। আর পাশাপাশি না-বললে অন্যায় হবে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতির জাদু আজও এতটুকু কমেনি। যেমন কমেনি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা।

বেশ লেগেছে কিন্তু চার বন্ধু অনিন্দ্য-উপল-অনুপম-সুরজিৎকে। অন্য রং এনে দিয়েছেন তাঁরা। ‘ভূমি’র ভেঙে যাওয়া নিয়ে ছোট্ট একটা ছোঁয়া আছে, মনে এসে লাগে। প্রাক্তন কথাটার আরেকখানা আদল ফুটে ওঠে। বিনীতরঞ্জন ছবির গতিকে নিজের আবহের সাযুজ্যে গেঁথে নিয়েছেন, যেমন ভাল কিছু গান আমাদের উপহার দিয়েছেন অনিন্দ্য আর অনুপম। সৌমিত্রবাবুর গলায় ‘হঠাৎ দেখা’ যদি একটি হয়, তাহলে দর্শকদের আরেকটি উপরি পাওনা অবশ্যই ইমন চক্রবর্তীর গলায় ‘তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর’, যা ইতিমধ্যেই অনেকের ভাল লাগার তালিকায় ঢুকে পড়েছে। খুব ভাল লেখা একখানা গান। আর ইমন গেয়েছেনও মনে রাখবার মতো করে।

ট্রেনের বাইরের দৃশ্যে ব্যবহৃত কম্পিউটার গ্রাফিক্স আরেকটু পরিপাটি হলে চোখে লাগত না। অবশ্য প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার উপস্থিতি সেই খামতিকে অনেকটাই ঢেকে দেয়। দুজনের কারওই বয়স বাড়েনি বলে মনে হল। ঠিক যেখানে তাঁরা একসঙ্গে ছবি করা থামিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের বয়সও সেখানেই থমকে গিয়েছে যেন। ‘প্রাক্তন’ এক কথায় সফল। বাঙালি হল-এ ফিরছে। এক সময় যেমন টেনে এনেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, যেমন হলমুখী হতে বারবার বাধ্য করে চলেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় বা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, তেমনই নন্দিতা-শিবপ্রসাদও তা পেরেছেন নিঃসন্দেহে। যে-কোনও শিল্পের ক্ষেত্রেই সেটা খুব জরুরি। বিশেষত মূলস্রোতে। আর ‘প্রাক্তন’ দেখতে যাওয়া দর্শকেরা পেয়ে যাচ্ছেন অনেক রকমের ইউএসপি-র এক দারুণ ব্লেন্ডিং ও প্যাকেজ। তাই হিট না হয়ে যায় না। কিন্তু শুধুমাত্র হিট-ফ্লপের বাইরেও তো এই শিল্পের একটা জমি, একটা আকাশ থাকে, যেখানে সিনেমার পরিভাষায়, বক্তব্য ও দর্শনের মাত্রা দিয়ে তৈরি হয় মাপকাঠিগুলো।
সফল এই পরিচালক-জুটি নিশ্চয়ই সৃষ্টির সেই সার্থকতা নিয়েও সমান আগ্রহী ও যত্নশীল, দর্শক হিসেবে এটুকুই আমার বিশ্বাস।

praktan Srijato
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy