সিজিও কমপ্লেক্সে শ্রীকান্ত মোহতা।—ছবি পিটিআই।
প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাইছেন না বিশেষ কেউ। কিন্তু টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে বৃহস্পতিবার সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা ঘুরপাক খেল, সেটা ‘কর্মফল’! আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক দহরম মহরমের মাসুলও শ্রীকান্ত মোহতাকে গুনতে হল বলে মনে করছে টলিউড।
সেই সঙ্গে স্টুডিয়োপাড়ার প্রশ্ন একটাই— এ বার ইন্ডাস্ট্রির কী হবে? কারণ শ্রীকান্ত মোহতা শুধু পয়লা নম্বর প্রযোজক নন, তিনি কার্যত টালিগঞ্জের একচ্ছত্র অধিপতি। প্রযোজনা, পরিবেশনা, ডিজিটাল প্রযুক্তির কিউব পদ্ধতিতে প্রদর্শন— সর্বত্রই প্রায় তাঁর একচেটিয়া সাম্রাজ্য।
এ দিন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিনেতা বলে ফেললেন, ‘‘একক আধিপত্যের জেরে আজ এমন অবস্থা যে, শ্রীকান্তদার অনুপস্থিতি কার্যত ইন্ডাস্ট্রির কাছে অস্তিত্ব সঙ্কটের উদ্বেগ বয়ে আনছে!’’ স্টুডিয়োমালিক প্রীতিময় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘শ্রীকান্তর উপস্থিতি, অনুপস্থিতির উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বহু মানুষের সংসার ওর উপর নির্ভরশীল। ও দীর্ঘ সময় না থাকলে, ইন্ডাস্ট্রির জন্য তা ভয়াবহ হতে পারে।’’
আরও পড়ুন: টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগে গ্রেফতার প্রযোজক শ্রীকান্ত
এমনিতেই টালিগঞ্জে হিট ছবি গুটিকয়েক। এর মধ্যে শ্রীকান্তদের গোষ্ঠী ছবির হিট-ফ্লপ নির্বিশেষে, শিল্পী-কলাকুশলীদের ঠিক সময়ে টাকা দেয় বলে ইন্ডাস্ট্রির খবর। নানা জায়গায় সিনেমা হলেরও পত্তন করেছে তারা। বড় পর্দা, ছোট পর্দা, ওয়েব-দুনিয়া, সবেতেই তাদের ‘শাসন’। শ্রীকান্ত নিজে তাঁর সংস্থার কাজের সৃষ্টিশীল দিকটা দেখতেন। সংস্থার এক মুখপাত্র অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘সংস্থার ছকে-বাঁধা কাজ নিজের ছন্দেই চলবে।’’
কিন্তু অনিশ্চয়তা কমছে না। শ্রীকান্তর অগ্রজপ্রতিম টালিগঞ্জের এক বিশিষ্ট চরিত্র বলছিলেন, ‘‘শ্রীকান্ত নিজের বিপদ নিজেই ডাকলেন। ইন্ডাস্ট্রিকেও বিপদে ফেললেন।’’
কী ভাবে? টালিগঞ্জের একটা বড় অংশের বক্তব্য, দুর্নীতির অভিযোগকে সামনে রেখে আসলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেরই মাসুল গুনলেন শ্রীকান্ত। এ রাজ্যে বাম জমানার পরিবর্তনের পরে ক্রমশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাছের লোক’ হয়ে ওঠেন তিনি। শাসক দলের সভা-মিছিলে বিনোদন-ব্রিগেডকে হাজির করা থেকে শুরু করে শাসক দলের কলাকুশলী সংগঠনের সঙ্গে টলিউডের রফাসূ্ত্রের খোঁজে বারবার তাঁকে তৎপর হতে দেখা গিয়েছে। এমনকি, দেবের মতো তারকাকে সংসদে পাঠানোর নেপথ্যে শ্রীকান্তই আসল লোক বলে ইন্ডাস্ট্রি ও রাজনৈতিক মহলের বিশ্বাস। সামগ্রিক ভাবে লোকসভা নির্বাচনের আগে এই গ্রেফতারিকে তাই রাজনৈতিক বার্তা হিসেবেই দেখছে টালিগঞ্জ।
এক প্রযোজকের কথায়, ‘‘এ দিনের ঘটনায় রাজ্যের শাসক দলকেই বার্তা দেওয়া হল বলে মনে হচ্ছে। হয়তো ঘুরিয়ে বিনোদন জগৎকেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হল। ইন্ডাস্ট্রিকে শাসক দলের সঙ্গে একাকার করে না দিলে এত কিছু হত না।’’ এখানেই উঠছে ‘কর্মফল’-এর প্রশ্ন। তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, শ্রীকান্ত দলের কর্মী নন। কিন্তু বিজেপি যে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ করছে, সেটা এই গ্রেফতারেও পরিষ্কার। সিবিআই খাঁচার তোতাপাখির মতো আচরণই করছে বলে অভিযোগ করেন পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়।
অনেকে মনে করাচ্ছেন, বিক্রয়কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে ২০১৪ সালে রাজ্যের অর্থ দফতরের তদন্ত শাখাই শ্রীকান্তর সংস্থার অফিসে হানা দিয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি শীর্ষস্তরের নির্দেশে ধামাচাপা পড়ে যায় বলে দাবি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যেমন বলছেন, ‘‘এটা আগেই হওয়া উচিত ছিল। পোর্ট ট্রাস্টের জমি নিয়ে গোলমালেও শ্রীকান্তর নাম জড়িয়েছিল।’’
কখন কী • সকাল ১০টা সিবিআই অফিসাররা এলেন কসবার মলে • ১০টা ১৫ শ্রীকান্ত মোহতা এলেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল তাঁর ১৯ তলার অফিসে • সাড়ে ১০টা শ্রীকান্তের অফিস থেকে ফোন পুলিশের এক কর্তার কাছে • ১০টা ৪৫ কসবা থানা থেকে পুলিশ এল • বেলা ১১টা মলের সামনে প্রায় দেড়শো বহিরাগত • ১টা সিবিআইয়ের ফোন নবান্নের দুই কর্তাকে • দেড়টা মল থেকে বেরিয়ে গেল পুলিশ • ৩ টে ১৫ শ্রীকান্তকে নিয়ে গেল সিবিআই • বিকাল ৪টে গ্রেফতারির কথা ঘোষণা
প্রভাব খাটিয়ে অন্য প্রযোজকদের কোণঠাসা করার অভিযোগের আঙুল শ্রীকান্তদের দিকে বারবার উঠেছে। এর মধ্যে প্রতিপক্ষ ব্যানারের ছবির প্রচারে ব্যাঘাত সৃষ্টি থেকে শুরু করে নিজের ছবি ভাল শোটাইম না-পেলে হলমালিক-পরিবেশকের লাইসেন্স বাতিল করানোর জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগও আছে। তাঁদের কারও কারও মুখেও ‘কর্মফল’ শব্দটা এ দিন শোনা যাচ্ছে।
শ্রীকান্ত বেশ কিছু সরকারি পদে ছিলেন। রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অধীনে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম অ্যাকাডেমি গঠিত হয়েছে গত বছর। ২৩ সদস্যের ওই কমিটিতে রয়েছেন শ্রীকান্ত। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটিতেও আছেন। কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটিরও তিনি সদস্য। এখন ওই কমিটিতে শ্রীকান্তকে রাখা হবে কি না, তা নিয়ে দোটানায় পুর প্রশাসন। অতীতে কুণাল ঘোষ গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁকে পুরসভার একটি কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy