এতক্ষণ যে মানুষটা ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন, রেকর্ডিং বুথে যাওয়ার সময় বডি ল্যাঙ্গোয়েজটা যেন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল তাঁর... তখন তিনি সর্বোচ্চ লেভেলের পারফর্মার।
গত বছর অগস্ট মাসের ঘটনা। সে দিন আমার সুরে গান রেকর্ডিং করবেন দিদি, আমার তো আগের রাত থেকেই ঘুম নেই। সকাল সকাল ফোন করলাম পেডার রোডের সেই বিখ্যাত বাড়িতে। ‘প্রভুকুঞ্জ’। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘দিদি, সব ঠিক আছে তো?’’ উত্তর এল, ‘‘বিলকুল। আমি টাইমে পৌঁছে যাব।’’
সকাল ১১টায় রেকর্ডিং, দশ মিনিট আগে তিনি স্টুডিয়োয় হাজির। সে দিন গল্প করতে করতে দিদি বলছিলেন, ৭৫ বছরের গানের কেরিয়ারে তিনি বোধহয় শুধু তিন কী চার দিন সময়ে রেকর্ডিংয়ে পৌঁছতে পারেননি। কোন কোন রেকর্ডিংয়ে দেরি হয়েছিল, কী কী কারণে দেরি হয়েছিল — সেটাও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে আছে দিদির।
আসার সঙ্গে সঙ্গে রিহার্সাল করলেন তিনি। রিহার্সাল শেষ হওয়ার পর আমি বললাম, ‘‘দিদি, এ বার রেকর্ডিং চালু করি?’’
এতক্ষণ যে মানুষটা ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন, রেকর্ডিং বুথে যাওয়ার সময় বডি ল্যাঙ্গোয়েজটা যেন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল তাঁর। হ্যাঁ, এই বয়সেও। রেকর্ডিং বুথের দিকে হাঁটার সময় যেন তিনি আর দিদি নন, তিনি তখন ‘নাইটেঙ্গল অব ইন্ডিয়া’। সর্বোচ্চ লেভেলের পারফর্মার।
ময়ূরেশ পাই
মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সেই আগের মতোই দাপটে মাইকের হাইট অ্যাডজাস্ট করলেন। আমি বললাম, ‘‘দিদি, পাশে চেয়ার আছে, অসুবিধা হলে আপনি চেয়ারে বসেও গাইতে পারেন।’’
আমার দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন, ‘‘ময়ূরেশ, চেয়ারে বসে আজ অবধি কোনও গান রেকর্ড করিনি। গাইতে হলে দাঁড়িয়ে গাইতে হয়।’’
রেকর্ডিং শুরু। চলল প্রায় তিন-চার ঘণ্টা। দেখলাম, কয়েকটা ছোট জায়গায় কারেকশন আছে। দিদিকে বললাম, ‘‘আপনি লাঞ্চ করে নিন, তারপর আমরা কারেকশনগুলো ঠিক করে নেব।’’ শুনে বললেন, ‘‘যে দিন রেকর্ডিং থাকে আমি তো সে দিন কিছু খাই না। ভরপেটে রেকর্ডিং হয় নাকি! স্রেফ চায়ে পিতি হুঁ। তুমি আমার জন্য পারলে আধ বাটি স্যুপ আনিয়ে দাও। ওটাই খাব।’’
ওপরের ঘটনাগুলো আপনাদের বলার পিছনে বিশেষ কারণ আছে। এগুলো না-জানলে আজকের এই ৮৭ বছরের ‘ভারতরত্ন’কে পুরোপুরি চেনা যাবে না।
আজও রেকর্ডিংয়ের সময় তাঁর রুটিন বদলায় না। মাইকের সামনে তাঁর আত্মবিশ্বাস আজও আগের মতো। আজও প্রত্যেকটা রেকর্ডিং তাঁর কাছে ‘আয়েগা আনেওয়ালা...’র মতোই নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার লড়াই।
এই জন্যই তিনি সবার ওপরে। এই জন্যই তিনি দিদি। এই জন্যই তাঁর দিদিগিরি আজও অব্যাহত।
লতা মঙ্গেশকর।
লতা মঙ্গেশকর ওয়ান্টস টু মিট ইউ
আমার সঙ্গে দিদির প্রথম আলাপ ২০০৩ সালে। সেই সময় আমার একটা সাঁই ভজনের অ্যালবাম করেছিলেন উনি। অ্যালবামের নাম ছিল ‘মেরে সাঁই’। তারপর দিদির সঙ্গে তেরোটা অ্যালবাম করে ফেললাম এই ক’বছরে। সেই থেকেই দিদির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। ইনফ্যাক্ট পরের মাস থেকে আরও একটা অ্যালবামের কাজ শুরু করছি দিদির সঙ্গে। তবে আজও দিদিকে দিয়ে রেকর্ডিং করানোটা কিন্তু মুখের কথা নয়। দিদি কার গান রেকর্ডিং করবেন সেটা পুরোপুরি ওঁর ওপর নির্ভর করছে। আর সেটার একটা ফিক্সড প্রসেস রয়েছে।
আপনি যদি দিদিকে দিয়ে রেকর্ডিং করাতে চান, তা হলে আপনার সুরগুলো একটা সিডিতে বানিয়ে পেডার রোডে পৌঁছে দিতে হবে। তারপর দিদি সেই গান শুনবেন। পছন্দ হলে তাঁর বাড়ি থেকে ফোন আসবে আপনার কাছে, ‘লতা মঙ্গেশকর ওয়ান্টস টু মিট ইউ’ বলে।
আমি কিশোরদার সঙ্গে ডুয়েট থাকলে ভয় পেতাম। হি ওয়াজ আ জিনিয়াস
এই ফোন পাওয়ার পর থেকেই শুরু হবে টেনশন। একে লতা মঙ্গেশকর, তাঁর ওপর ওঁর বাড়ি গিয়ে দেখা করা। পৃথিবীর যে কোনও মিউজিক ডিরেক্টরের রাতের ঘুম উড়ে যেতে বাধ্য। তবে বিশ্বাস করুন, আপনার টেনশন কাটাবেন কিন্তু লতা মঙ্গেশকর নিজেই।
ওঁর বাড়িতে যদি ঢোকেন, তা হলেই বুঝতে পারবেন কী বলতে চাইছি। পুরো বাড়িতে সিনেমার নামগন্ধ নেই। কোনও সিনেমার গান বাজে না। সেক্রেটারির দাপাদাপি নেই। শুধু এক দিকে অল্প ভলিউমে ভজন শুনতে পাবেন। আর সারা বাড়ি জুড়ে রয়েছে দারুণ পারফিউমের গন্ধ। তবে গোটা বাড়িতে কোনও দেখনদারি নেই। এর পর তিনি নিজেই এসে দেখা করবেন। অসম্ভব নম্রভাবে কথা বলবেন। জানতে চাইবেন আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্বন্ধে। তারপর যদি তাঁর পছন্দ হয়, তবেই তিনি আপনার গান রেকর্ডিং করবেন।
মন দিয়ে শোনো, সলিলদা ঠিক এমন একটা সুর করেছিল
প্রায় ১৩ বছর ওঁকে কাছ থেকে দেখার পর আমিও নানা ভাবে ওঁর কাছে পুরনো দিনের দিকপাল আর্টিস্ট এবং মিউজিক ডিরেক্টরদের সম্বন্ধে নানা কথা জানার চেষ্টা করেছি। তিনিও প্রাণ খুলে কথা বলেছেন আমার সঙ্গে। তবে সব কথা অবশ্যই মিডিয়াতে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তবে সেই আড্ডাগুলো থেকেই বুঝতে পেরেছি, বাঙালি শিল্পীদের তিনি আজও ভুলতে পারেননি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হোন কী মান্না দে, কী কিশোর কুমার, কী গীতা দত্ত। কথায় কথায় দেখেছি উনি প্রায়ই বলেন এই চারজনের কথা। এসডি বর্মন কী সলিল চৌধুরী কী পঞ্চমদাকে নিয়ে কোনও কথা দিদি বলবেন না, এমন আড্ডা আমি আজ অবধি দেখিনি।
এমনকী নতুন গানের কোনও অন্তরা বা মুখরা পছন্দ হলে দেখেছি দিদি বলছেন, ‘‘মন দিয়ে শোনো, সলিলদা ঠিক এমন একটা সুর করেছিল’’ বা ‘‘এ সব আজকে হচ্ছে! পঞ্চম কবেই করে গেছে।’’ বুঝেছি, এই বয়সেও তাঁদের প্রতি কী অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল তিনি।
আজও সময় পেলে রফিসাবের ভজন
শুধু কী মিউজিক ডিরেক্টর! আড্ডা মারতে বসে কত কথা বলেন দিদি। সুর নিয়ে মদনমোহনজি-র পাগলামো, সি রামচন্দ্র-র বৈচিত্র। একদিন কথা হচ্ছিল কিশোরদা-র ব্যাপারে। দিদি সে দিন বলছিলেন, তাঁর সবচেয়ে বেশি টেনশন হত কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট থাকলে। এমনিতেই কিশোরকুমার নাকি রিহার্সালের ধার ধারতেন না। আর প্রথম থেকেই ইয়ার্কি মারতেন সবার সঙ্গে। দিদি বলছিলেন, ‘‘কিশোরদার সঙ্গে রেকর্ডিংয়ে কনসেনট্রেট করাই যেত না। মিউজিক ডিরেক্টররা কী অসম্ভব বিরক্ত হতেন আমাদের ওপর। তবে আমি কিশোরদার সঙ্গে ডুয়েট থাকলে ভয় পেতাম। হি ওয়াজ আ জিনিয়াস।’’
রফিসাবের মতো আর্টিস্ট আর হবে না। যত ভাল মানুষ, তত বড় শিল্পী
কিশোরদা ছাড়াও দেখেছি আজকাল দিদি পুরনো দিনের শিল্পীদের মধ্যে যাঁর কথা প্রায়ই বলেন, তিনি মহম্মদ রফি। প্রায়ই শুনি, ‘‘ময়ূরেশ, রফিসাবের মতো আর্টিস্ট আর হবে না। যত ভাল মানুষ, তত বড় শিল্পী।’’ চুপিচুপি আপনাদের জানিয়ে রাখি, দিদি কিন্তু আজও সময় পেলে রাতে রফিসাবের ভজন শোনেন।
আমি ডিপ্লোম্যাটিক হলে রয়্যালটি নিয়ে সরব হতাম না
অনেককেই বলতে শুনেছি, দিদি ভীষণ ডিপ্লোম্যাটিক, পলিটিকালি কারেক্ট কথা বলেন। আমার কিন্তু কোনও দিন সেটা মনে হয়নি।
হয়তো দিদি সবার সামনে বলেন না, কিন্তু যাদের উনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন তাদের সামনে দিদি মনপ্রাণ খুলে কথা বলেন। ইনফ্যাক্ট একদিন আমি জিজ্ঞেসও করেছিলাম, আপনার ভাল লাগে লোকে যখন আপনাকে ডিপ্লোম্যাটিক বলে?
আমার কথা শুনে দিদি বলেছিলেন, ‘‘আমি যদি ডিপ্লোম্যাটিক হতাম তা হলে কি আমি রয়্যালটি নিয়ে এত সরব হতাম? সেই সময় যেটা আমার দাবি ছিল, তার জন্য লাভবান হয়েছেন আর্টিস্টরাই। তা হলে কেন আমাকে ডিপ্লোম্যাটিক বলা হবে?’’
গাড়িতে কোন সিডি বাজবে, সে ব্যাপারে অসম্ভব খুঁতখুঁতে
আজকে দিদি বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকেন। কাছের মানুষদের সঙ্গে গল্প করেন, পুজাআচ্চা করেন নিয়ম করে। এই নিয়ে সময় কাটে।
এ ছাড়া আর একটা জিনিসও রয়েছে তাঁর ডেইলি রুটিনে। তা হল ক্রিকেট দেখা। ম্যাচের দিন সকালে একদম টস থেকে দিদি টিভির সামনে বসেন। ক্রিকেটকে দিদি কতটা ভালবাসেন সেটা তাঁর সঙ্গে বসে ম্যাচ না দেখলে বুঝতে পারবেন না। অনেক সময় ঘরে ঢুকে দেখেছি সচিনের সঙ্গে গল্প করছেন, ইয়ার্কি মারছেন।
এ ছাড়াও আর একটা মজা হল দিদির সঙ্গে গাড়ি করে কোথাও যাওয়া। গাড়িতে বসার আগে দিদি ড্রাইভারের হাতে নানা সিডি তুলে দেন। কখনও দেখেছি ন্যাট কিং কোল শুনছেন। কখনও আমির খান কী বড়ে গুলাম আলি। এ ছাড়া নতুন গায়কদের মধ্যে অসম্ভব স্নেহ করেন সোনু নিগমকে। সোনুর গান হলেই দেখেছি দিদি মন দিয়ে শুনছেন। গাড়িতে কোন সিডি বাজবে, সে ব্যাপারে দিদি অসম্ভব খুঁতখুঁতে।
আমি একদিন ওঁর সিডির গোছ থেকে ‘সংস অব লতা মঙ্গেশকর’ চুপিচুপি চালিয়ে দিয়েছিলাম। দেখি দিদি নিজের গান আজও কী অসম্ভব মনোযোগ সহকারে শুনছেন। সে দিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত মন দিয়ে কী শুনছেন? বলেছিলেন, ‘‘আর্টিস্ট কোনও দিন শান্তি পায় না ময়ূরেশ। আজও নিজের গানগুলো শুনলে মনে হয়, ইস্ ওই জায়গাটা যদি আর একটু বেটার গাইতে পারতাম।’’
এই হলেন লতা মঙ্গেশকর।
আজ হয়তো অনেক সময় বয়সের কারণে শরীর ভাল থাকে না, কিন্তু বিশ্বাস করুন দিদির কাছে গেলেই যেন একটা অন্য রকম এনার্জি পাওয়া যায়।
ওঁর কাছের লোকেরা বলেন এই দ্যুতি নাকি ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল। তাই জন্যই ওঁরা সরস্বতী বলেন ওঁকে।
আমরা বলি দিদি।
দুনিয়া বলে লতা মঙ্গেশকর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy