Advertisement
E-Paper

গানের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হব এই বাসনা বরাবর ছিল, ‘হেমন্তকণ্ঠী’ হব কোনও দিন ভাবিইনি

“লোকে বলে, তুমি আমার মতো গান করো। কিন্তু তোমার কণ্ঠে নিজস্বতা আছে”, শিবাজিকে বলেছিলেন প্রয়াত গীতিকার-সুরকার-শিল্পী।

শিবাজি চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৫ ১৬:৩০
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছায়ায় শিবাজি চট্টোপাধ্যায় আলোকিত?

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছায়ায় শিবাজি চট্টোপাধ্যায় আলোকিত? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

আমি তখন জলসায় গাইতাম। সব শিল্পীর সব ধরনের গান শোনাতাম। মান্না দে, শ্যামল মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোর কুমার এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। পাড়ায় পাড়ায় ডাক পড়ত। শ্রোতারা আমার কণ্ঠ পছন্দ করতেন। নানা গানের ফরমায়েশ জানাতেন। তত দিনে আমার কিছুটা পরিচিতিও হয়েছে। বন্ধুরা, গানের দুনিয়ার কিছু মানুষ একদিন ডেকে বললেন, ‘তোর কণ্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ভাল মানায়। তুই অন্য গান আর করিস না। ওঁর গানগুলোই কর।’ সকলের অনুরোধ মেনে আস্তে আস্তে হেমন্তদার গানে বেশি মনোযোগ দিলাম। সব জলসায় তখন আমার কণ্ঠে শুধুই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। তাতে কিছু উপার্জনও হত।

আমার বাসনা ছিল, গানকে পেশা করব, প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হব। ‘হেমন্তকণ্ঠী’ হব কখনও ভাবিনি। প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হতে যা যা প্রয়োজন যেমন তালিম, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, গলার যত্ন— সবই নিতাম। আকাশবাণীতে গাইব, ছবিতে নেপথ্যশিল্পী হিসাবে আমার গলা শোনা যাবে, গানের রেকর্ড বেরোবে, স্বপ্ন দেখতাম সারাক্ষণ। নানা জায়গায় তদ্বিরও করতাম। ১০ বছর চেষ্টার পর অজয় দাসের সুরে ‘বিচার’ ছায়াছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করলাম। অজয়দাই প্রথম থেকে সুযোগ দিতে থাকলেন। তার পর থেকে প্রতি বছর একটি করে ছবির নেপথ্যশিল্পী আমি। অজয়দাও কিন্তু আমার কণ্ঠে হেমন্তদার গান শুনেই পছন্দ করেছিলেন!

সাল ১৯৮৫। ইন্ডাস্ট্রির সকলেই জানেন, জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গাই। বেহালাবাদক সমীর শীল এই কারণে খুব স্নেহ করতেন। ওঁর মাধ্যমে দাদার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ। ততদিনে তরুণ মজুমদারের ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবির গান হেমন্তদা নিজেই গেয়ে রেকর্ড করেছেন। কিন্তু কোনও কারণে নিজের গাওয়া গান তাঁর পছন্দ হয়নি। পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক সবাই বিকল্প খুঁজছেন। সমীরদা হেমন্তদার কাছে আমার নাম করলেন। বললেন, ‘ও আপনার গান গায়। বেশ ভাল গায়। একবার দেখতে পারেন।’ সমীরদার কথায় সায় দিয়েছিলেন এইচএমভি সংস্থার রেকর্ডিস্ট সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এ দিকে আমার ঠিকানা, ফোন নম্বর কিছুই ওঁদের কাছে নেই।

অনেক সে সব জোগাড় করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ওঁরা। হেমন্তদার বাড়িতে গিয়ে গান শোনালাম। দাদা খুশি হলেন। বললেন, “লোকে বলে তুমি আমার গান করো। আমার মতো গায়কি। কিন্তু তোমার কণ্ঠে নিজস্বতা আছে। তোমাকে দিয়েই হবে। না হলে আর হবে না।” ওঁর আশ্বাস পেয়ে একটা গান রেকর্ড করলাম। সেটা শুনে তরুণবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি। হেমন্তদা আমায় ডেকে বললেন, ‘শিবাজি তৈরি হও। গানগুলো তোলো। আমিও শেখাব তোমাকে।’ তার পর সমস্ত গান রেকর্ড হল। আমি সিংহভাগ গাইলেও হেমন্তদার কণ্ঠও অল্প ছিল। শ্রোতারা শুনে বিভ্রান্ত! কোনটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কোনটা শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর? কিছুতেই আলাদা করতে পারছেন না তাঁরা। খুব উপভোগ করেছিলাম আমি।

ছবি সাংঘাতিক হিট হয়ে গেল। এই ছবির পর থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর পরের সমস্ত ছবিতে আমায় দিয়ে গাইয়েছেন। কণ্ঠে মিল থাকার কারণে আমার প্রতি দুর্বলতাও তৈরি হয়েছিল। স্নেহ করতেন খুব। আরও একটি কারণে পছন্দ করতেন আমায়। আমি কিন্তু ওঁকে কোনও দিন হুবহু নকল করিনি। ওঁর গান নিজের মতো করে গাইতাম। অন্ধ অনুকরণ করিনি বলেই হয়তো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ পেয়েছি। আমার গানে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। শ্রোতারাও হয়তো এই জন্যই আমার গান শুনেছেন। আমি যদি আর একজন ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’ হতে যেতাম, তা হলে ব্যর্থ হতাম। এগোতেই পারতাম না। রাহুল দেববর্মণের মতো সুরকার আমায় ডেকে গাওয়াতেন না।

তার পরেও বলব, সকলের ভাগ্য তো সমান নয়। যত গেয়েছি তার অধিকাংশ গান হিট হয়নি। যদি হত তা হলে আমার পক্ষে কিছুটা সুবিধা হত। তাই এত গাওয়ার পরেও শ্রোতাদের কাছে শুধুই ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবির জনপ্রিয় গায়ক হয়েই রয়ে গেলাম।

Hemanta Mukherjee Shibaji Chatterjee Remembrance
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy