Advertisement
E-Paper

লিও কাহিনি

আপনি যখন এটা পড়ছেন, টিভিতে তখন চলছে অস্কার অ্যাওয়ার্ডস। শহর মাতোয়ারা লিওনার্দো দি’ক্যাপ্রিও-র নতুন ছবি নিয়ে। অবশেষে ‘টাইটানিক’য়ের জ্যাক কি আজ জিতবেন অস্কার? লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়।লিওনার্দো যেন হলিউডের কর্ণ। যাঁর বীরত্ব (এ ক্ষেত্রে অভিনয় প্রতিভা) নিয়ে কোনও তর্ক নেই। শুধু ভাগ্যটা অর্জুনের মতো নয়।

শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:২৫

ভালুকের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে। বাইসনের লিভার কাঁচা খেতে হয়েছে। ঘোড়ার ফাঁপা শবদেহে ঢুকে আশ্রয় নিতে হয়েছে। বরফের নদীর উপর দিয়ে হামা দেওয়াও বাকি নেই।

বিশ্বের মিডিয়াকুল যে দৃশ্যগুলোর কথা লিখে লিখে ছিবড়ে করে ফেলেছে, কলকাতা ইতিমধ্যে তা দেখেও ফেলল। লিওনার্দো দি’ ক্যাপ্রিও-র ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ শুক্রবারই মুক্তি পেয়েছে এখানে। উনিশ শতকের মার্কিন অভিযাত্রী হিউ গ্লাসকে পর্দায় দেখে মনে হবেই, অস্কারের জন্য আর ঠিক কী কী করণীয়?

লিও ইতিমধ্যেই গোল্ডেন গ্লোব এবং বাফটা পেয়ে বসে আছেন। পেয়েছেন স্ক্রিন অ্যাক্টর্স গিল্ড পুরস্কার। এখনও অবধি ‘রেভেন্যান্ট’-এর পুরস্কার-দৌড় মসৃণ। ফলে অনেকেরই মনে হচ্ছে, অস্কার ঘোষণাটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। আবার উল্টো মতটি হল, ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ভয়ঙ্কর কষ্টসাধ্য ছবি হতে পারে। কিন্তু এটা লিও-র সেরা ছবি নয়।

মজার কথা হল, অস্কার কমিটির কাছে ‘পিচ’ করার সময়েও ছবির পিছনে কত পরিশ্রম, কত প্রতিকূলতা, লিও কত ঝুঁকি নিয়েছেন ইত্যাদি সবিস্তার বলা হয়েছে। বিশুদ্ধ অভিনয়ের দিকটা কম। সমালোচকরা বলছেন, ছবিটার প্রতিটি ফ্রেম যেন অস্কার জেতার জন্য মরিয়া। দেখো আমরা কী ভীষণ কষ্ট করছি, এই ঘোষণাটা সেখানে জাঁকালো। এক জন আকাডেমি সদস্য বলেই দিয়েছেন তিনি লিওনার্দোকে ভোট দেননি। তিনি মনে করেন, একটা ছবি খুব কষ্ট করে তৈরি, এটা অস্কার পাওয়ার কারণ হতে পারে না।

লিওনার্দোর অভিনয়ের ভক্তরাও সম্ভবত বলবেন না যে, ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ই লিওর সেরা। কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেল, এ বার অন্তত লিও-র অস্কারটা পাওয়া উচিত, এই ভাবটাই আপাতত প্রবল। তুলনায় প্রতিযোগিতাও কিছুটা সহজ। ব্রায়ান ক্র্যান্সটনের ট্রাম্বো নিয়ে তেমন হইচই নেই। এডি রেডমেইন আগের বারই পেয়েছেন। ম্যাট ড্যামন-এর ‘দ্য মার্শিয়ান’ কতটা কী হবে, বলা যাচ্ছে না। লিও-র ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন বরং মাইকেল ফাসবিন্দার (স্টিভ জোবস)। অনেকের মতে, তিনিই এ বারের যোগ্যতম দাবিদার। আজকের এই কাগজ হাতে পাওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জানা হয়ে যাবে, ডায়াসে কে উঠছেন!

কিন্তু তাতে যে-তথ্যটা বদলে যাবে না, সেটা হল এ বারে প্রধান আলোচনাটাই ছিল লিওকে ঘিরে। এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছিল, যেন এ বার শিকে না ছিঁড়লে লিও-র আর আশাই নেই। অথচ লিও অভিনয় ছেড়ে নির্বাসনেও যাচ্ছেন না, তাঁর হাতে আর তেমন ইন্টারেস্টিং ছবি নেই এমনও নয়। বয়স মাত্র ৪১। তা হলে কেন এমন মরিয়া উত্তেজনা? আসলে এতগুলো বছর ধরে ‘তা হলে কি এই বার’ থেকে শুরু করে ‘না হে হল না’য় এসে শেষ করা মিডিয়ারও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বলিউড পুরস্কার রজনীতে অমিতাভ বচ্চন মঞ্চে উঠলেই যেমন রেখার দিকে তাকানো ক্যামেরার আবশ্যিক কর্তব্য, অস্কারে তেমন সেরা অভিনেতা ঘোষণার মুহূর্ত এলে লিও-র মুখে সময় নিয়ে ক্যামেরা তাক করাটাই রেওয়াজ। এক জন অভিনেতার কাছে এটা কম চাপ না! লিও তার মধ্যেই একের পর এক ছবি করে যাচ্ছেন। স্টিফেন স্পিলবার্গ থেকে জেমস ক্যামেরন, মার্টিন স্করসেসে থেকে ক্রিস্টোফার নোলান, উডি অ্যালেন-তারান্তিনো থেকে ক্লিন্ট ইস্টউড, হলিউডের প্রায় সব কটা জঁরের মহারথীদের সঙ্গেই তাঁর কাজ করা হয়ে গিয়েছে। তিনি বারবার বলেন, যে কাজটা আপনি সবচেয়ে ভাল পারেন, আপনি যদি সেটা করতে পারেন, খুশি থাকতে পারেন, তা হলেই জানবেন, জীবনে অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে আছেন।

কথাটা লিও-র পক্ষে বলা সাজে। কারণ জীবনে কোনও কিছুই খুব অনায়াসে আসেনি তাঁর জন্য। হিপি দম্পতির সন্তান। জন্মের এক বছরের মধ্যে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। লস অ্যাঞ্জেলেসের অতি গরিব মহল্লায় মায়ের কাছে বড় হওয়া বাচ্চাটা স্রেফ টাকা রোজগারের তাগিদেই টিভিতে মুখ দেখিয়েছিল।

ইস্কুলে যখন যেতেন, লিওর বড় বড় চুল নিয়ে বাকিরা পিছনে লাগত। লিও র‌্যাগিং এড়ানোর জন্য ক্লাউন সেজে সবার মন জয় করার চেষ্টা করতেন। পরবর্তী কালে একটু প্রান্তিক, একটু খ্যাপাটে ধরনের চরিত্র লিওনার্দো কেন এত ভাল করবেন, তার একটা উত্তর সম্ভবত তাঁর স্কুলছুট শৈশবেই পাওয়া যাবে। টিভি কমার্শিয়াল থেকে সিরিয়াল, সিরিয়াল থেকে সিনেমা। বিশ্বের অন্যতম দামি নক্ষত্র হয়ে ওঠার আগে অনেক চড়াই তাঁকে ভাঙতে হয়েছে। রেভেন্যান্ট অস্কারযোগ্য কি না, আজ এ প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি মনে রাখা দরকার, এ যাবৎ লিওর সেরা কাজগুলোও কিন্তু অস্কার পায়নি।

উনিশ বছর বয়সে প্রথম যে বার লিও অস্কার মনোনয়ন পান, ‘হোয়াট ইজ ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ’-এ (১৯৯৩) তিনি ছিলেন মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোর। জনি ডেপের ভাই। অস্বাভাবিকতার অভিনয়ে প্রায়শই যে ধরনের অতিরেক সেটাকে প্রায় প্যারোডির পর্যায়ে নিয়ে যায়, লিওর অভিনয় ছিল তার চেয়ে আশ্চর্য রকম আলাদা। ১৯৯৫-এর ‘বাস্কেটবল ডায়েরিজ’ ছবিটিকেও লিও-র অন্যতম সেরা ধরা হয়। কিন্তু অস্কার মনোনয়ন নেই। টোটাল ইকলিপস-এ সমকামী কবির চরিত্র লিও করেছেন কত দিন আগে। পুরস্কার পাননি। অল্প দিন পরে বাজ লুরমানের ‘রোমিও + জুলিয়েট’ তাঁকে বার্লিনে পুরস্কার এনে দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত যে তর্কের মীমাংসা হয়নি, সেটা হল ‘টাইটানিক’-এ (১৯৯৭) লিও-র অস্কার মনোনয়ন এল না কেন। এটা সত্যি যে, কেট উইনস্লেট মনোনয়ন পেয়েও সেরা নায়িকা হননি। লিও-ও যদি মনোনয়ন পেতেন, তা হলেও পুরস্কার জুটত না-ই ধরা যায়। কারণ সে বারের বিজেতা তো স্বয়ং জ্যাক নিকলসন (অ্যাজ গুড অ্যাজ ইট গেটস)। কিন্তু তাই বলে লিওনার্দো, সারা পৃথিবীকে কাঁদানো ভালবাসার শেষ মহাকাব্যের নায়ক লিওনার্দো, মনোনয়নও পাবেন না?

লিওনার্দোর অস্কার-ভাগ্য নিয়ে স্টোরি লেখা সেই যে শুরু হল, আজ অবধি থামতে পেল না। কখনও তাঁর মনোনয়ন না পাওয়া নিয়ে, কখনও মনোনয়ন পেয়েও খালি হাতে ফেরা নিয়ে। লিওনার্দো যেন হলিউডের কর্ণ। যাঁর বীরত্ব (এ ক্ষেত্রে অভিনয় প্রতিভা) নিয়ে কোনও তর্ক নেই। শুধু ভাগ্যটা অর্জুনের মতো নয়। লিও ধারাবাহিক ভাবে ভাল ছবিতে ভাল অভিনয় করে গিয়েছেন। কিন্তু সেরার লড়াইয়ে অবিসংবাদী হতে পারেননি। লিও অস্কার না পাওয়ায় যাঁরা দুঃখ পেয়েছেন, তাঁরাও এ কথা বলার সুযোগ পাননি যে, যাঁরা পেলেন তাঁরা না পেলেও পারতেন। একই বছরে (২০০২) লিও ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ আর ‘গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্ক’ করলেন। একটাতে তাঁর সঙ্গে টম হ্যাঙ্কস, অন্যটায় ড্যানিয়েল ডিলুইস। অস্কার মনোনয়নে প্রত্যাশিত ভাবে ড্যানিয়েলই থাকলেন, ঢাকা পড়লেন লিও। দ্বিতীয় অস্কার মনোনয়ন পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হল ‘দ্য অ্যাভিয়েটর’ (২০০৪) পর্যন্ত!

লিও-র সফর: অস্কার তবু ব্রাত্য

হোয়াট ইজ ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ (১৯৯৩)

টাইটানিক (১৯৯৭)

ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান (২০০২)

দ্য উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট (২০১৩)

আবার দেখুন, ২০০৬-এ লিওনার্দো করলেন ‘দ্য ডিপার্টেড’ আর ‘ব্লাড ডায়মন্ড’। ‘ডিপার্টেড’ ৫টা মনোনয়ন পেল, ব্যতিক্রম লিও। তিনি মনোনীত হলেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল ‘ব্লাড ডায়মন্ড’-এর জন্য। ফল যা হওয়ার তাই। পরের বছর আরও বিস্ময়কর। তারান্তিনোর-র ‘জ্যাংগো আনচেইনড’। লিওনার্দো এক নৃশংস দাসমালিক। খাওয়ার টেবিলে হাত কেটে ফেলার সেই দৃশ্য মেথড-অভিনয়ের অভিধানে ঢুকে যেতে পারে, কিন্তু অস্কার-তালিকায় ঠাঁই পায়নি। লিওনার্দো চতুর্থ মনোনয়ন পেলেন ‘দ্য উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট’য়ের জন্য। কিন্তু সাধারণ ভাবে যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করলে অস্কার এসে থাকে, এটা সেই গোত্রে পড়ল না। লিও-ও অস্কার পেলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাথু ম্যাকনিকে জড়িয়ে ধরলেন। অথচ কেট উইনস্লেট ওপরা উইনফ্রে শো-তে স্পষ্ট বলেছিলেন, যদি লিওর কেরিয়ারের দিকে তাকান...যে সব ছবি ও করেছে, আমার কাছে অন্তত, আমার মতো অনেকের কাছে লিও ওর প্রজন্মের শীর্ষ অভিনেতা।

কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো না। স্করসেসের শিষ্য লিও-র ঝুলিতে যা ছবি আছে, সেটাই কি তাঁর পরিচয় নয়? অস্কার কি একমাত্র কষ্টিপাথর হতে পারে কখনও? এ দেশে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে এসে। তাতে কী বা এল গেল? রিচার্ড বার্টন, পিটার ওটুল কোনও দিন অস্কার পাননি। এ কালে জনি ডেপও পাননি। তাতে কি অভিনেতা হিসেবে এঁদের দর কিছুমাত্র কমেছে? হিচকক কোনও দিন সেরা পরিচালক হননি। ‘সিটিজেন কেন’, ‘ভার্টিগো’, ‘২০০১ স্পেস ওডিসি’, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ কোনওটাই সেরা ছবির পুরস্কার পায়নি। তাতে কি এগুলোর কাল্ট স্টেটাস কোনও ভাবে আটকে গিয়েছে?

বরং এইটে বলা যাক, সাইবেরিয়াতে লিওর জন্য মেয়েরা তাদের গয়না গলিয়ে একটা ট্রফি বানাচ্ছেন। লিওকে দেবেন। এই আদর লিও-র প্রজন্মে আর কোনও অভিনেতা পেয়েছেন কি? বললাম না, লিও পর্দায় অদ্যাবধি ভালবাসার শেষ মহাকাব্যের নায়ক (‘টোয়াইলাইট’ মনে রেখেই বলছি)। তাঁর ঝুলিতে অস্কার আসুক না আসুক, হৃদয়ের রাজমুকুট তাঁর জন্য রাখা আছে। নীল চোখের লিওনার্দো যে প্রত্যেকটা মেয়েকে ডানা মেলতে শিখিয়েছেন!

leonardodicaprio oscar movie entertainment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy