প্রতি বছর যেমন একাধিক তারকার কোল আলো করে আসে নতুন প্রাণ, তেমনই একাধিক তারকা ছেড়ে যান আমাদের চিরতরে। কেউ কেউ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নিভৃতে, কোনও তারকার অসুস্থতার খবরে সাধারণ মানুষ থাকেন আশঙ্কায়। কিছু মৃত্যু একেবারে অপ্রত্যাশিত-ও হয়। ঠিক যেমন শেফালি জ়রীওয়ালা বা জ়ুবিন গার্গের মৃত্যু। ২০২৫ সালে বলিউড ও টলিউডের কোন কোন তারকা ছেড়ে গেলেন আমাদের?
জ়ুবিন গার্গ: জ়ুবিন গার্গ শুধু একজন গায়ক ছিলেন না। একটা গোটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। অসমীয়া, বাংলা ও হিন্দি-সহ একাধিক ভাষায় গান গেয়েছিলেন তিনি। ২০০০ সালের মধ্যে অসমের মানুষের অন্যতম প্রিয় শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন জ়ুবিন। ২০০৬ সালে ‘গ্যাংস্টার’ ছবিটি মুক্তি পায়। জ়ুবিনের কণ্ঠে সেই ছবির ‘ইয়া আলি’ গান ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। তবে বরাবরই ছক ভাঙতে ভালবাসতেন জ়ুবিন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালীনও মুম্বই ছেড়ে চলে আসেন অসমে। নিজের মাটির টানে। চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎই খবর মেলে, আর নেই গায়ক জ়ুবিন গার্গ। খবরের প্রথম দমক সামলে একে একে উঠে আসে নানা তথ্য। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতি হয় গায়কের। শিল্পীর দেহ তাঁর রাজ্যে ফিরলে এক অন্য অসমকে দেখে গোটা ভারত। রাস্তায় নামে মানুষের ঢল। গোটা রাজ্য যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। এককথায় ‘ঘরের ছেলে’র মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি অসম। তাঁর মৃত্যু নিয়ে এখনও চলছে তদন্ত। গ্রেফতার হয়েছেন একাধিক।
ধর্মেন্দ্র: বছরের শেষে নভেম্বরের ২৪ তারিখে প্রয়াত হন বলিউডের বর্ষীয়ান অভিনেতা ধর্মেন্দ্র। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে বলিউডের একটা যুগের অবসান হল। বলিউডের ‘হি-ম্যান’ বলা হত তাঁকে। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চাকরি ছেড়ে লুধিয়ানা থেকে মুম্বই পাড়ি দেন ধর্মেন্দ্র। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা তৈরি করা খুব সহজ কথা নয়। অভিনয়ে সুযোগ না পেয়ে তিনি পঞ্জাব ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিলেন। এর পরে ‘পত্থর অউর ফুল’ ছবির মাধ্যমে সাফল্য আসে। সেই শুরু। এর পরে সাফল্যের গ্রাফ কেবল ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। ছ’দশক ধরে অভিনয়জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ধর্মেন্দ্র। ৩০০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সিনেমা ছাড়াও কবিতার প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অগাধ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শরীর ভাঙতে থাকে। অনেক দিন ধরেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। মাঝে শোনা যায়, অভিনেতাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। কিন্তু, সেই তথ্য অস্বীকার করা হয় অভিনেতার পরিবারের তরফে। এর মাঝে, তাঁর মৃত্যুর খবরও ছড়ায়। সেই খবর ভুল প্রমাণ করে হাসপাতাল থেকে বাড়িও ফেরেন অভিনেতা। বাড়িতে নিয়ে এসে তাঁকে চিকিৎসার মধ্যেই রাখা হয়। কিন্তু, বাড়ি ফেরার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই প্রয়াত হন অভিনেতা। তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ‘ইক্কিস’ মুক্তি পাবে ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি।
শেফালি জ়রীওয়ালা: মাত্র ৪২ বছরে থমকে যায় অভিনেত্রী শেফালি জ়রীওয়ালার জীবন। ২০০২ সালের ‘ইন্ডি পপ মিউজ়িক’ ভিডিয়ো ‘কাঁটা লাগা’ গানে ঝড় তুলেছিলেন শেফালি। টুকটুকে ফর্সা চেহারা, চুলের বেণীতে বাঁধা নীল ফিতে, ঝলমলে টপ, জিন্সের প্যান্ট— শেফালির এই পোশাক রীতিমতো আলোড়ন ফেলে সেই সময়। আমৃত্যু দর্শকের নজরে ওই পরিচয়েই বেঁচেছিলেন অভিনেত্রী। ২৮ জুন মধ্যরাতে হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হয় অভিনেত্রীর। পরে শোনা যায়, তিনি নাকি ‘অ্যান্টি-এজিং’ বা বার্ধক্যরোধক চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। আর তার ফলেই এই আকস্মিক মৃত্যু! বছরের মাঝে শেফালির আকস্মিক মৃত্যুর খবর রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকে একটা গোটা প্রজন্মের কাছে।
আসরানী: অক্টোবরে ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন গোবর্ধন আসরানী। ‘শোলে’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘মেরে আপনে’, ‘বাওয়র্চি’, ‘অভিমান’, ‘সরগম’-এর মতো জনপ্রিয় ছবির অত্যন্ত পরিচিত মুখ। সত্তরের দশকে রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র বা আমজাদ খানের পাশাপাশি তাঁর অভিনীত ‘জেলার’ চরিত্রটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বার্ধক্যজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শেষের দিকে ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পরে অভিনেতার মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আনে তাঁর পরিবার। কারণ, এমনই চেয়েছিলেন অভিনেতা। তিনি নীরবেই চলে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর শেষ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার।
মুকুল দেব: দীর্ঘ দিনের অভিনয়জীবন। সুস্মিতা সেনের বিপরীতে ‘দস্তক’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। চিরাচরিত নায়কের মতোই চেহারা, শিক্ষিত ও সুদর্শন। কিন্তু বলিউডে নায়ক হয়ে সাফল্য মেলেনি তেমন। ধীরে ধীরে পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসাবেই রয়ে গেলেন তিনি। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় অভিনেতা মুকুল দেবের। তাঁর অকাল প্রয়াণে স্তব্ধ হয়ে যান অনুরাগীরা। অসুস্থ ছিলেন অনেক দিন ধরেই। মে মাসের শুরুতেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তার পরে মৃত্যু। অনেকের মতে, মুকুলের এই অসুস্থতার নেপথ্যে ছিল একাকিত্ব এবং অবসাদ। বলিউডের একদা আলোচিত এই অভিনেতার বিয়ে হয় দিল্লিনিবাসী শিল্পার সঙ্গে। তবে ২০০৪ সাল থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন তাঁরা। ২০০৫ সালে মেয়ে সিয়াকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে দিল্লি চলে যান শিল্পা। আর ফেরেননি। বিচ্ছেদের পর থেকেই নাকি একা থাকতে শুরু করেন অভিনেতা, মদ্যপান শুরু করেন। মায়ের মৃত্যুর পরে আরও একা হয়ে যান। শেষমেশ সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেন অভিনেতা।
পঙ্কজ ধীর: বিআর চোপড়ার ‘মহাভারত’-এর কর্ণ চরিত্রে পঙ্কজ ধীরের অভিনয় এখনও দর্শকমনে গেঁথে আছে। দীর্ঘ অভিনয়জীবনের বেশিরভাগ সময় খলচরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। যদিও কেরিয়ারের শেষের দিকে এসে ‘ভাল’ চরিত্রে অর্থাৎ ইতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। চলতি বছরের ১৫ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অভিনেতা । মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৮। দীর্ঘ দিন ধরেই ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন পঙ্কজ। তবে ধীরে ধীরে সেরেও উঠেছিলেন। কিন্তু, চলতি বছরেই আবার তাঁর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অভিনেতা। অস্ত্রোপচারও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়: বছরের শুরুতে যে সব তারকাকে আমরা হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে অন্যতম গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৩। অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে ১৯৪২ সালের ২৫ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন গায়ক। বাবা ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। ছোট থেকেই গান লিখে তাতে সুর দিয়ে গাওয়ার ঝোঁক ছিল তাঁর। প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে প্রচারের আলোয় আনে তাঁর গাওয়া ‘আমি বাংলায় গান গাই’। তাঁর গানে উঠে এসেছে মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের কথা। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন প্রতুল। দীর্ঘ দিন ধরে ভুগছিলেন। গান গাইতেন তিনি, কিন্তু কোনও যন্ত্রী ছাড়া। কখনও নিজের গাল, কখনও বা বুক বাজিয়ে, তুড়ি দিয়ে, হাততালি দিয়ে গাইতেন নিজের বাঁধা গান।
জয় বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘হীরক জয়ন্তী’, ‘মিলন তিথি’, ‘জীবন মরণ’, ‘নাগমতি’-সহ বহু ছবির নায়ক ছিলেন জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। নব্বইয়ের দশকে বাংলা সিনেমায় তাঁর আত্মপ্রকাশ। যে সময় তাপস পাল-অভিষেক চট্টোপাধ্যায়-প্রসেনজিতেরা প্রায় প্রতিষ্ঠিত, সেই সময় আত্মপ্রকাশ জয়ের। সৌম্যকান্তি, ছিপছিপে, চেহারায়-চোখেমুখে সারল্য। ‘চপার’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়েছিল দর্শকমহলে। যদিও নিজের সাফল্য বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি তিনি। শোনা যায়, আচরণগত সমস্যা ছাড়াও তাঁর ছিল মদে আসক্তি। দীর্ঘ অসুস্থতার শেষে ২৫ অগাস্ট প্রয়াত হন বাংলা ছবির একসময়ের আলোচিত নায়ক জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২। শেষের দিকে যোগ দিয়েছিলেন রাজনীতিতেও। তৃণমূলে যোগ দেন প্রথমে। পরে রাজনৈতিক মতাদর্শ বদল করে বিজেপিতে যোগদান করেন। ব্যক্তিগত জীবনেও টানাপড়েন ছিল তাঁর। প্রচারের আলো থেকে সরে শেষ জীবনটা আড়ালেই কাটান জয়।
কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়: ৭ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন অভিনেতা কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ দিন ধরে রোগে ভুগছিলেন অভিনেতা। তাঁর দীর্ঘ অভিনয়জীবনে বহু খ্যাতনামী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। যদিও সারাজীবন তিনি পার্শ্বচরিত্রেই অভিনয় করেছেন। পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কল্যাণের প্রথম ছবি তপন সিংহের ‘আপনজন’। সেই সময় তিনি ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘ধন্যি মেয়ে’-সহ ৪০০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করছেন। তপন সিংহ ও অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। অভিনয় করছেন সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-তে। বড়পর্দার পাশাপাশি ছোটপর্দা, সিরিজ়েও সমান দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সুজয় ঘোষের হিন্দি ছবি ‘কহানী’, সিরিজ় ‘তানসেনের তানপুরা’, ধারাবাহিক ‘এক আকাশের নীচে’-তে তাঁর অভিনয় ভোলার নয়। তাবড় অভিনেতা, পরিচালকদের ছবিতে কাজ করলেও কেউ তাঁকে প্রধান চরিত্রে ভাবেননি! সেই নিয়ে নাকি আক্ষেপ ছিল অভিনেতার।