Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আমরা কম নই

এরা কেউ বাহা। কেউ মৌরি। কেউ ঝিলিক। বড় পর্দার নায়িকাদের যদি গ্ল্যামার থাকে, এঁদের আছে সাঙ্ঘাতিক প্রভাব! টিভি বাক্সের তিন জনপ্রিয় নায়িকার সামনে মনোজিত্‌ সরকার।শুভশ্রী। শ্রাবন্তী। নুসরত। মিমি। বড় পর্দায় বছরে সাকুল্যে একটা-দু’টো ছবি মুক্তি পায় এঁদের। সেই ছবির হোর্ডিং, পোস্টার শহর, গ্রাম জুড়ে। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় শ্যুটিংয়ের অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা। নায়কদের জড়িয়ে গসিপ।

মানালি, রণিতা এবং শ্রীতমা।

মানালি, রণিতা এবং শ্রীতমা।

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

শুভশ্রী। শ্রাবন্তী। নুসরত। মিমি। বড় পর্দায় বছরে সাকুল্যে একটা-দু’টো ছবি মুক্তি পায় এঁদের।

সেই ছবির হোর্ডিং, পোস্টার শহর, গ্রাম জুড়ে।

খবরের কাগজের পাতায় পাতায় শ্যুটিংয়ের অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা।

নায়কদের জড়িয়ে গসিপ।

সুইজারল্যান্ড-সানফ্রান্সিসকো-মিশরে শ্যুটিং। তার পর মুক্তির দিন তোলপাড় প্রিমিয়ার। চলকে পড়া গ্ল্যামার। শহর, মফস্বল, গ্রামের ‘মাচা’ শো-তে মাঝরাতে বডিগার্ড বেষ্টিত নায়িকারা চোখঢাকা রংবেরঙের চশমায় মার্সেডিজ, অডি করে পা ছোঁয়ান। চোখধাঁধানো পোশাক। মাত্র দশ মিনিট হাত নেড়ে চুমু ছুড়ে চলে যান। বিনিময়ে দেদার পারিশ্রমিক।

তাঁদের গাড়ি এগিয়ে যায় মাচা ছেড়ে। জনস্রোত ভেঙে। গাড়ির চাকার উড়ানে কি চাপা পড়ে যায় কিছু ঈর্ষা, দীর্ঘশ্বাস! আর এই দীঘশ্বাস, ঈর্ষা কি সেই সব দিনরাত কাঁপানো টিভি স্টারদের যাঁদের না হলে শহর থেকে গ্রাম বাঙালির আটপৌরে জীবন ফাঁকা।

পর্দার নায়িকারা আমাদের ঈর্ষা করে

শ্রীপর্ণা: ‘আঁচল’-এর টুসু

প্রশ্নটা শুনে ‘বউ কথা কও’ সিরিয়ালের মানালি দে বললেন, “দেব। সঙ্গে শুভশ্রী। সন্ধে সাতটায় ওরা স্টেজে উঠল। লোকে হাততালি দিল। হইচইও হল। ওদের পরেই মাঝ রাতে আমি উঠলাম। একজন দর্শকও বেরিয়ে যাননি। তুমুল হাততালি। মৌরি, মৌরি চিত্‌কার। দেব-শুভশ্রী তো প্যাকেজ। প্রেমের আগেও। পরেও। মাচায় দেবের ক্রেজ সব থেকে বেশি। কিন্তু সিনেমার নায়িকাদের ক্রেজ ছোট পর্দার অভিনেত্রীদের থেকে বেশি নয়। এই দর্শকদের ভালবাসায়ই তো আমার জন্ম। শুভশ্রী-শ্রাবন্তীরা যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করছে, তাতে আমাকে মানাবে কি না জানি না। আমি যে সব চরিত্রে অভিনয় করি, সে সব চরিত্রে কি ওদের মানাবে?”

মানালির মনে হয়, লুক হোক কী অভিনয়, কখনও বড় পর্দার তারকাদের চরিত্র পেলে একটু অন্য ধাঁচের অভিনয় করতেন। যেমন ‘সখী’তে ঈশানীর চরিত্র করার সময় মৌরী থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। গ্রামে, মফস্সলে তিনি হয়তো মৌরী। শহরে ঈশানী। “সে দিন সাউথ সিটি মলে আমাকে দেখিয়ে কয়েক জন ছাত্রছাত্রী বলল, ‘ওই দ্যাখ, মানালি।’ খুব আনন্দ পেলাম,” ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে ‘সখী’র ফ্লোরে বসে কথাগুলো বলছিলেন মানালি।

ব্রেসব্রিজে ‘মা’-এর সেটে শ্রীতমার তখন ভয়াবহ কস্টিউম। ঝিলিক মা হবে। স্ফীতোদর। শাড়িতে প্যাঁচানো সারা শরীর। “ওমা, ঈর্ষা হবে কেন! শুভশ্রী-শ্রাবন্তীরা আড়াই ঘণ্টার মেহমান। ঝিলিক দর্শকদের নিজের বাড়ির মেয়ে। আমাকে দেখার জন্য মাচায়, স্টেজে যেতে হবে না। রাস্তাঘাটে দেখা হলে মা-মাসিমারা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আহা মা, তোর কী কষ্ট!’ এত সব আদর সিনেমার নায়িকারা পান নাকি?” পাল্টা প্রশ্ন শ্রীতমার।

টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে দু’পা দূরত্বে ন’নম্বর স্টুডিয়োতে নিজেই মেক আপ নিচ্ছিলেন রণিতা দাস। ‘ইষ্টিকুটুম’-এর সাজঘরে বসে ‘বাহা’ হয়ে উঠছিলেন। তাঁর মতে বাংলা সিনেমায় নায়িকাদের বেশি ভাবতে হয় বক্স অফিস নিয়ে। টেলিভিশনে এর উল্টো। টিআরপির বেশিটাই ‘বাহা’-কেন্দ্রিক। প্রতিটা শটেই দর্শক চান বাহাকে। রণিতা রীতিমতো সরব, “ঈর্ষা আমি করি না। বরং বড় পর্দার নায়িকারা ঈর্ষা করতে পারে। তিন বছর ধরে বাহা শাড়ির ক্রেজ পশ্চিমবঙ্গে।” সত্যিই, মৌরি লজেন্স, ঝিলিক চুড়িদার দেদার বিকোচ্ছে সর্বত্র।

আমাদের পোশাক বাংলার ফ্যাশন

‘আঁচলে’র টুসুও এদের সঙ্গে একমত। বললেন, “শুনেছেন শ্রাবন্তী শাড়ি? শুভশ্রী সালোয়ার? পাওলি নাইটি। মিমি কুর্তা? বর্ধমানে যখন শো করি, তখন শুভশ্রীর থেকে কিছুমাত্র কম হাততালি পাই না।”

একই স্টাইলের পোশাকে অভিনয় করতে একঘেয়ে লাগে না? “হ্যাঁ, লাগে। তাই ইভেন্টে বাহার স্টাইলে গেলেও মাচায় জিন্স, স্কার্ট, চুড়িদার সব পরতে পারি,” বললেন রণিতা। শ্রীতমা বললেন, “ঝিলিকের পোশাকেই তো ট্রেন্ড সেট করেছি। অন্য কিছু প্রয়োজন নেই।” অন্য দিকে গ্রামের মেয়ে মৌরি এখন ঈশানী হয়ে সব পোশাকই পরতে পারে। তাই মানালির দুঃখ নেই।

তবু ধারাবাহিকের অভিনেত্রীরা সিনেমার অভিনেত্রীদের থেকে আলাদা গুরুত্ব তো পান। সে কথা মেনেই মানালি বললেন, “এই বিভেদটা তৈরি করেন প্রযোজকেরা। পর্দা ছোট-বড় হতে পারে। কিন্তু আমি তো একশো শতাংশই দিই। টিআরপি কম হলে কি ছেড়ে কথা বলবে?”

ফিল্মে তো বটেই, ফিল্মস্টারদের মাচায় অর্থপ্রাপ্তিও বেশি।

যার ফলে শুভশ্রী-শ্রাবন্তী-পাওলিরা স্বচ্ছন্দে মার্সেডিজ-অডি চড়তে পারেন। বহুতলে বড় ফ্ল্যাট নিতে পারেন। “হ্যাঁ, মানছি ওরা দামি গাড়ি চড়ে। আমার গাড়িটা ছোট। কিন্তু মঞ্চে পারফরম্যান্সে আমি এগিয়ে,” আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য শ্রীতমার। রণিতার গলায় অবশ্য ঝাঁঝ। “কেউ তো নগদে বাড়ি-গাড়ি কেনে না। ডাউনপেমেন্ট সামান্য। বাকি ইএমআই। চাইলে আমিও কিনতে পারি। এ সব ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ঈর্ষা নেই। আর ফ্ল্যাট? সে-ও একই ব্যাপার। স্রেফ ইএমআই আর কেয়ার অব মাচা।” প্রায় সহমত মানালিও, “আমি কম দামের গাড়ি চড়ি না। আর সেটা নিজে কিনেছি। এন্টারটেনমেন্ট হাউসগুলো নিয়মিত ভাল পারিশ্রমিক দেয়। কাজেই একটা ফ্ল্যাটও আছে।”

ফিল্মের আউটডোর মানেই ইদানীং আমেরিকা, লন্ডন, মিডল ইস্ট, মিশর কিংবা অ্যান্টার্কটিকা। ধারাবাহিকের দৌড় দার্জিলিং, দিঘা, শান্তিনিকেতন ব্যস। মানালির বক্তব্য ধারাবাহিকের সীমিত বাজেট। এটাই তাদের দৌড়। শ্রীতমা কিন্তু বেশ উত্তেজিত, “যাক না বিদেশ। কলকাতার ঘেমো রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বোলপুরের মেঠো পথ-ই আঁকড়ে ধরে রয়েছে ‘মা’-এর দর্শকেরা। বছরের পর বছর। রণিতাও একই কথা বললেন, “বিদেশের লোকেশনে ছোট পর্দার খরচ ওঠা সহজ নয়। বাজেট ছোট। তাই আয় অনুযায়ী ব্যয়। পুরী, দিঘা, মন্দারমণি, দার্জিলিং-এই কাজ সারি। মন খারাপ হলেও কী-ই বা করা যাবে...”

বাহা-মৌরি-টুসু হওয়াই সব নয়

এত সব সাম্য-অসাম্যের মাঝে যত দিন ‘ইষ্টিকুটুম’, তত দিনই তো ‘বাহা’। তার পর? “আরে, এই তার পরের জন্যই তো অপেক্ষা করে আছি তিন বছর ধরে। প্রতিদিন আদিবাসী লুক আর ভাষার বাইরে রণিতাকে অন্য চোখে দেখুক দর্শকেরা, অন্য পোশাকে চিনুক। আমি ‘বাহা’ থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আর সেটা অবশ্যই ফিল্মে।” অর্থাত্‌ বাহা মাইনাস রণিতা? হ্যাঁ, বাহাকে দর্শকের পছন্দ। বাহাকে চাই। রণিতাকে দরকার নেই। চরিত্রটা হিট অ্যাকট্রেস নয়। যে কেউ ‘বাহা’ সাজতে পারে। ওই রকম করে কথা বলতে পারে। রণিতার কী ক্রেডিট? ও কে? কান পাতুন, অনেকেই বলছে। আগে বলত। এখনও বলে। আমি কেউ নই।

এক সময় স্রেফ পড়াশোনা করব বলে, ‘আমায় পড়ার সময় দাও’ বলে রাগ-অভিমান-কান্নাকাটি... এই প্রতিবেদকের সামনেই। আগুন লাগার আগে দাসানি স্টুডিয়োতে বাহা আগুন হয়ে ফেটে পড়েছিলেন। “এই ধারাবাহিক চলার সময় ১৪-১৫ ঘণ্টা স্টুডিয়োতে অভিনয় করে উচ্চমাধ্যমিক ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছি। কলেজে ভর্তি হয়ে রেগুলারে পড়তে চেয়েছিলাম। তখনই বুঝেছি, ‘বাহা’ নয়, রণিতার কী বিপদ! বাহা টিআরপি রোজ চাই। সব শটে। ওরা কোনও দিনই রণিতার ভবিষ্যত্‌ চিন্তা করবে না। নিজেকে বললাম, ‘বেরিয়ে আয় রণিতা’” বলেন রণিতা।

মানালির ‘অচিন পাখি’ নামে একটা ছবি মুক্তি পেয়েছে। তেমন সাড়া ফেলল কই? জানালেন, “‘অচিন পাখি’ ব্যবসায়িক ভাবে তেমন সফল না হলেও কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রশংসা পেয়েছে।” মানালি তার পর সে ভাবে ভাল ছবির অফার পাননি। গুচ্ছ গুচ্ছ বাজে ছবি করার থেকে ভাল সিরিয়াল করলে দর্শক বেশি আনন্দ পান। মহিলাতান্ত্রিক ছোট পর্দায় আমরা প্রথম সারির নাগরিক। পুরুষতান্ত্রিক বড় পর্দায় শ্রাবন্তী, শুভশ্রীরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন।

তবে শ্রীতমা কিন্তু অভিমানী। বললেন, “কে ঝিলিক! যে কেউই এটা করতে পারত। আমার থেকেও ভাল করত। সানন্দা টিভিতে ‘আমার নাম জয়িতা’-তে আমার ছিল সেকেন্ড লিড, ‘তানি’। ইউনিটের দাদা-দিদিরা এখনও ওই নামেই আমাকে ডাকে। এই ‘ঝিলিক’য়ের জন্য এক বছর ড্রপ দিয়েছি পড়াশোনায়। এখানে সারা দিন শু্যটিং করেও ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছি।”

“মৌরি ছোট পর্দার ট্রেন্ডসেটার হয়ে থাকলে, আজ টেলিভিশনের সেরা মুখ বাহা,” বললেন মানালি। ‘বেহুলা’র পায়েল, ‘আঁচল’-এর টুসু মানে শ্রীপর্ণা, ‘রাশি’র গীতশ্রী, ‘জলনূপুর’য়ের কাজু অর্থাত্‌ লাভলি, ‘বোঝে না সে বোঝে না’র মধুমিতা-রা ফিল্মের নায়িকাদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ক্রমেই বড় হয়ে উঠছেন ছোট পর্দায়।

হংসরাজের টিয়ার নাকে নোলকের বহু বছর পর মৌরির নাকে নোলক ছোট পর্দায় হিট। এর পর অজস্র গ্রাম্য বালিকা-বধূদের নাকে নোলকের নিয়মিত ব্যবহার ছোট পর্দার সঙ্গে বড় পর্দাতেও দেখা যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রেও ট্রেন্ড সেটার ছোট পর্দাই, জানালেন মানালি। বিনোদনের বাংলায় যাত্রা-নাটককেও প্রায় উদরস্থ করছে বাংলার সিরিয়াল। বড় পর্দার বড় নায়ক প্রসেনজিত্‌-দেব, জিত্‌-দের ক্রেজ যে ভাবে ছোট পর্দা ব্যবহার করেছে, সে ভাবে শুভশ্রী-শ্রাবন্তীদের দিয়ে হয়নি। এক সময় মিমি, নুসরত, শ্রাবন্তীরা ছোট পর্দার ফসল হওয়ার পরও আর ধারাবাহিকে আসতে চাননি সে ভাবে। আর দেব-প্রধান ‘ডান্স বাংলা ডান্স’য়ে নুসরতরাই বা কতটুকু জ্বলে ওঠেন!

অনেকে যা-ই ভাবুন, এঁরা ভীষণভাবে মনে করেন, বাংলার ছোট পর্দার বড় স্বীকৃতি মুখ্যমন্ত্রীর সক্রিয় সহযোগিতায়। তিন নায়িকাই এ ব্যাপারে অকপট। গত ফিল্ম উত্‌সবে বাংলার পঞ্চকন্যাদের পাঁচটি পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন পাঁচ সিরিয়ালের কন্যা। এমনকী নেতাজী ইন্ডোরে উত্‌সব শুরুর দিনেও মুখ্যমন্ত্রী বিগ-বি-দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন রণিতাদের।

তবু তিন জনপ্রিয় টেলিভিশন অভিনেত্রীরই লক্ষ্য ফিল্ম। যেখানে ভাল অভিনয়ের স্বীকৃতি থেকে যাবে ভবিষ্যতের গভের্। ধারাবাহিক আজ আছে, কাল নেই। নায়িকাদের জীবনও আজ আছে, কাল বলে কিছু নেই। তাই তিন জনই নিছক নায়িকা নন, ভাল অভিনেত্রী হতে চান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE