Advertisement
E-Paper

টেক থ্রি

ফিল্ম সমালোচক নন। ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও না। এ বার ‘টেক ওয়ান’ বিতর্কে সেলেব থেকে আমদর্শক। শুনলেন সংযুক্তা বসুফিল্ম সমালোচক নন। ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও না। এ বার ‘টেক ওয়ান’ বিতর্কে সেলেব থেকে আমদর্শক। শুনলেন সংযুক্তা বসু

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৪ ২১:৫৯

ফিল্ম নগ্ন হলে যদি এগিয়ে যাওয়া হয়, এমন এগিয়ে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।

কৌশিক দাস

‘টেক ওয়ান’য়ের গল্পটা অসাধারণ। রিয়েলি গ্রেট।

অন্বেষ ভট্টাচার্য

যদি সানি লিওনের বাংলা ভার্সান দেখতে চান, তা হলে ‘টেক ওয়ান’ দেখুন....

শ্রীঞ্জয় সেন

এই রকম হাজার মন্তব্য এখন উড়ে বেড়াচ্ছে ‘টেক ওয়ান’ ছবিটাকে ঘিরে। ফেসবুকে- টুইটারে। কফিশপে-ঘরোয়া আড্ডায়। সিনেমা হলের সামনে। মিডিয়ায়।

আর এই সূত্র ধরেই ছবির পরিচালক মৈনাক ভৌমিক বলছেন “লভ ইট অর হেট ইট, ইউ কান্ট ইগনোর মাই ফিল্ম”।

ফোনের ও প্রান্ত থেকে এক উচ্চপদস্থ বিশিষ্ট তরুণী শিক্ষাবিদ বললেন, “পাগল, এই গরমে ‘টেক ওয়ান’ দেখতে যাব? আমি এই ধরনের ছবি তো দেখি না। মৈনাক ভৌমিকের ওই সব কে দেখবে!” উঁচু পদের ব্যাঙ্ককর্মী মোহন মিত্র বললেন, “আমি না দেখেই বেশ বলতে পারি এই ছবি কোনও মিষ্টি গল্প নয়, যেখানে একটা হার্ড কোর সত্যিও আছে। তা হলে কেন যাব?”

তা হলে এই ধরনের ছবি বানিয়ে একজন প্রযোজকের লাভ কী? যদি সচেতন আমজনতাই এই ভাবে দূরে সরে যান? শুধুই বিতর্কের ঝড় তোলা? আর কিছু নয়? “দেখুন বিতর্ক তোলার কথা ভেবে নয়, বুদ্ধিমত্তা আর বোধের প্রকাশ আছে এমন ছবি বানাতে চেয়েছি। এবং সে ক্ষেত্রে বারবারই দেখছি মৈনাক এমন ধরনের ছবি বানায় যেটা ইয়ং জেনারেশনের মানসিকতার সঙ্গে খুব ভাল যায়। ছবির জন্য টাকা বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু নগ্নতা দেখাতে চেয়ে নয়,” বলছেন এই ছবির প্রযোজক ফিরদৌসল হাসান।

ছবির প্রায় প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ওরফে নায়িকা দোয়েল মিত্র তাঁর অভিনীত সিনেমার জন্য আবক্ষ উন্মুক্ত নগ্নতায় আসঙ্গে লিপ্ত। গভীর চুম্বনে আকর্ষিত দুই নারীপুরুষকে দেখে দর্শক টানটান হয়ে বসেন।

আর তার পর?

গল্পে নেমে আসে অন্ধকার। ওই ছবির এমএমএস ক্লিপিং ছড়িয়ে পড়ায় স্বস্তিকার হতাশা, অবসাদ, সেই সঙ্গে স্বামীহারা মেয়ের নিঃসঙ্গতা তো আছেই। এত বিষণ্ণতা নিয়েও রিলিজের তিন সপ্তাহ বাদেও ছবি চলছে বাংলার মোট পঁয়ষট্টিটা হলে। যেখানে ‘অপুর পাঁচালী’র মতো প্রশংসিত ছবি, ‘টু স্টেটস’য়ের মতো পপুলার কালচারের ছবি চলছে, সেখানে ‘টেক ওয়ান’এর মতো ‘ওম্যান অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটি’ নিয়ে ছবির ভূমিকা কতটা? কেনই বা তা মাল্টিপ্লেক্স চেনে এখনও বহাল? মাল্টিপ্লেক্স ট্রেড অ্যানালিস্ট পঙ্কজ লাডিয়া বলছেন, “ছবি রিলিজের প্রথম উইক এন্ডে ৫০% হল ভরা ছিল। পরের সপ্তাহে উইক এন্ডে দর্শকের হার ছিল ৩০%- ৪০%। এতে আমাদের মোটামুটি একটা লাভও হয়েছে। আজকাল এই হারের দর্শক পাওয়াও কম নয়।”

যদিও নির্মাতারা এ কথা স্বীকার করতে চাননি বিমুক্তি জয়সূর্যম পরিচালিত ‘ছত্রাক’ ছবিতে নগ্ন দৃশ্যে পাওলির অভিনয়ের এমএমএস ক্লিপ বাজারে ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষের যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তারই হালকা ছায়ায় তৈরি গল্প নিয়ে ছবি ‘টেক ওয়ান’। তবু এই ঘটনাই যে ছবির বীজ তা আঁচ করতে অসুবিধে হয় না। ছবি দেখে একটা প্রশ্নই প্রথমে মাথায় আসে, দর্শক আজ পাওলিকে কী ভাবে দেখছেন? একজন সমাজ সচেতন সিনেমাপ্রেমী অভিনেত্রী হিসাবে? যিনি একটা ছবিকে সম্পূর্ণতা দেওয়ার জন্য দরকারে উত্তেজক ‘লাভ মেকিং’য়ের দৃশ্যেও স্বচ্ছন্দ ভাবে অভিনয় করেন? আর সেই পাওলিরই প্রতিরূপ হয়ে ওঠা ‘টেক ওয়ান’য়ের দোয়েল মিত্র কি পেরেছেন মৈনাকের ছবির সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে যেখানে একজন শিল্পীর শিল্পবোধই শেষ কথা?

প্রশ্ন শুনে পরিচালক অঞ্জন দত্ত বললেন, “পাওলি তো অন্যায়ই করেনি যে তার সঙ্গে আপস করার প্রশ্ন ওঠে। অন্যায় করেনি ‘টেক ওয়ান’ ছবির দোয়েল বা স্বস্তিকাও। কোনও খেদ বা পাপবোধই বা কেন থাকবে যদি ছবিতে নগ্নতার প্রয়োজন হয়? ‘টেক ওয়ান’ ছবিটা সেন্টিমেন্টাল হয়েই যেতে পারত। হয়নি মৈনাকের চিত্রনাট্য আর স্বস্তিকার টানটান অভিনয়ের গুণে। সবাই কি এক রকম ছবি বানাবে নাকি? আমি এক রকম ছবি বানাব, কৌশিক (গঙ্গোপাধ্যায়) আর এক রকম ছবি বানাবে, সৃজিত কিংবা মৈনাক আর এক রকম ছবি বানাবে। তবেই না মজা।”

অঞ্জনের কথার সঙ্গে মিলে যায় বেঙ্গালুরুর অ্যাপ্লয়েড সোশিওলজির ছাত্রী মৌমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত। তিনি মনে করেন দোয়েল যা করে তা এক ধরনের আত্মবিশ্বাস থেকে করে। কোনও হতাশা থাকলেও তার মধ্যে কোনও দ্বিচারিতা নেই। তবে বাংলার দর্শকের মানসিকতার তুলনায় সময়ের চেয়ে এগিয়ে এই ছবি। অসরকারি নামী স্কুলের শিক্ষিকা নাফিসা কাদেরের চোখে ‘টেক ওয়ান’ যতই আলোড়ন তুলুক নেগেটিভ পাবলিসিটি করে, আসলে গল্পটা ভীষণ ‘ক্লিশে’। প্রিয়া সিনেমা থেকে বেরিয়ে তরুণী গৃহবধূ সুস্মিতা বললেন, “ছবি নিয়ে যে আলোচনাই হোক না কেন আসলে পরিচালকের প্রয়াসটাই খুব সাহসী। তার কারণ এমএমএস ক্লিপ দেখে প্রচার মাধ্যম, স্টুডিওপাড়া যখন তোলপাড় তখনও দোয়েল যেমন নিরুত্তাপ, তেমনি একটি বিতর্কিত মননশীল ছবিতে অভিনয়ের জন্য যখন সে পুরস্কৃত হয় তখনও নিরাসক্ত। মৈনাকের সাহসটা এইখানেই।”

কিন্তু সাহসী ছবি বানালে যদি এত বিরূপ সমালোচনা হয় তা হলে কি পরিচালকেরা সেই স্পর্ধা দেখাবেন না? ফেসবুকে আর টুইটারে উপচে পড়বে কুরুচিকর মন্তব্য? “সাহসী ছবি বানিয়ে বিফল হওয়া তো এটা নয়। বরং আত্মবিশ্বাস বাড়া উচিত মৈনাকের, এই কারণে যে সে এমন একটা মানবিক ও সামাজিক গল্প বলতে পেরেছে যা দর্শককে ভাবাচ্ছে। আর ভাবাচ্ছে বলেই তাঁরা বিরক্ত,” বলছেন সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র। অন্য দিকে অনুপম রায়ের মতে এ ছবি মৈনাকের সব চেয়ে পরিণত ছবি।

পরিচালক অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী ছবির প্রশংসা করেও বলেন যে, আজ পঞ্চাশ বছর বয়সে এই ছবি বানাতে বসলে, তিনি সম্পূর্ণ অন্যরকম ট্রিটমেন্ট করতেন। মৈনাক সবে তিরিশের কোঠায়। অন্য দিকে মেক আপ শিল্পী অনিরুদ্ধ চাকলাদার বলছেন “স্বস্তিকার জীবনে যে ঘটনাগুলো ঘটে তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরও অনেক প্রবল হতে পারত। যেমনটা হয়েছিল পাওলির বাস্তব ঘটনার সময়। আমরা সেই মধ্যবিত্ত দ্বিচারিতার সাক্ষী।”

আইনক্সের এক দর্শক হল থেকে বেরোতে বেরোতে তাঁর সঙ্গীকে বলছিলেন, “আরে ছবি যেমন হোক, তাতে এত গালাগালি থাকবে কেন? মুখ খারাপ করা কথাগুলো শুনেছিস?” হ্যাঁ, এই ছবিতে যে ধরনের গালাগালি আছে তা শুনে দর্শকসমাজের অধিকাংশ বিহ্বল হলেও পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় বলছেন, “বহু মানুষ আছে যারা অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে। জীবনে যদি তা থাকে তবে সিনেমায় থাকবে না কেন? সৃজিতের ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকে আমার ‘কাঙাল মালসাট’সবেতেই গালাগালি ছিল। তবে নগ্নতা নিয়ে যে সব প্রশ্ন উঠছে তা এই ছবির বিষয় নয়। এক মেয়ের সঙ্গে তার চার পাশ ও সময়ের সংঘর্ষই এ ছবির প্রধান বিষয়।”

সেলিব্রিটিরা যাই বলুন, কিছু দর্শক আবার মানতে রাজি নন ‘টেক ওয়ান’য়ের অস্বস্তিকর উপস্থিতি। নন্দন থেকে ছবি দেখে বেরিয়ে আসছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের ক্রিমিনাল অ্যাডভোকেট এলিট্রা সিংহ। কেমন লাগল জিজ্ঞেস করায় প্রায় মামলার রায় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “দেখুন পাওলির ব্যাপারটা আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। পারবও না। আর এই ছবি আলটিমেটলি আমাদের মাটির সঙ্গে যায় না। সাহসী ছবি হয়েছিল ‘পরমা’।” পাশ থেকে আর এক জন মহিলা দর্শক বলে ওঠেন, “কিন্তু একটা ব্যাপারই বুঝলাম না, এই ছবির মেসেজটা কী?”

আর এই মেসেজ শব্দটাতেই মৈনাকের সব থেকে আপত্তি। তিনি বলেন, “আমি সীতার বঞ্চনা আর বনবাসকে প্রতীক হিসাবে এনেছি, মনে হয় এর চেয়ে বেশি মেসেজ দেওয়ার কিছু নেই। বিদেশি ছবিতে এমন গল্প আর ট্রিটমেন্ট তাঁরা

হামেশাই দেখেন।”

এক বান্ধবীর সঙ্গে ছবিটা দেখতে গিয়েছিলেন জুন মাল্য। বান্ধবীটিও জুনের মতো সিঙ্গল। পাওলি এবং স্বস্তিকা দু’ জনেরই আত্মবিশ্বাসকে তারিফ জানিয়ে জুন বলেন, স্বস্তিকার জীবনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে তাঁরা নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছেন। এবং এইখানেই ছবিটা একটা নির্দিষ্ট জীবনধর্মে পৌঁছয়।

জীবন যেমন চলার তেমনি চলবে। সিনেমার শটের ‘টেক ট’-‘টেক থ্রি’ হতে পারে। টেক থার্টি থ্রিও হতে পারে। কিন্তু জীবনের চিত্রগ্রহণে টেক টু বলে কিছু নেই। সেই জন্যেই এত বিতর্ক এ ছবির পিছু ছাড়ছে না।

পরের টেকে ছবির শট সংশোধন হয়। জীবনে হয় না। এটাও অবশ্য মৈনাক ভৌমিকের আর এক ধারণা।

sanjukta basu take three
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy