সেই ব্যাগটা এখনও কাঁধে।
এমনই একটা ব্যাগ ‘অপুর সংসার’য়ে অপুর কাঁধেও ছিল। আর আজকে এই অশীতিপর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাঁধেও ঝুলছে। একই ভাবে। শুধু এখনকার ব্যাগটা লেদারের। পরনে কমলা টি শার্ট আর নীল ট্র্যাক প্যান্ট। যেন এই মাত্র জগিং করে এলেন। অথচ তখন বাজে বেলা দশটা। ঘনঘন মোবাইল বাজছে। বিভিন্ন মানুষ ঘরে ঢুকছেন। সংক্ষেপে তাঁদের দরকারি কথা সেরে চলে যাচ্ছেন। পনেরোই অগস্টের সকালেও এতটাই ব্যস্ত তিনি। ক্রমাগত ফোন ধরছেন। কথা বলছেন। কাউকে বা বলছেন একটু পরে ফোন করতে।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘চা খাবেন তো?’
—হ্যাঁ, লাল চা।
উনি বললেন, ‘আমিও তাই।’
আবার বেজে ওঠে মোবাইল। সামান্য কথা বলে রেখে দিতেই জিজ্ঞাসা করলাম আপনার মোবাইলটা তো সব সময় বাজছে দেখছি। কথাও বলছেন। হোয়াটস্অ্যাপ ইনস্টল করেছেন?
না। আমি কম্প্যুটার, মোবাইল এই সব সম্পর্কে পরিপূর্ণ অশিক্ষিত।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের চ্যালেঞ্জটা নিলেন না? তা হলে তো দেখতে পেতেন কত লাইক পড়ছে।
দেখুন সবাইকে যে সব কিছু জানতে হবে তার কোনও মানে নেই। সব ব্যাপারে সবার যে আগ্রহ থাকবে তাও নয়।
আপনার নাতি রণদীপের কাছে কখনও শেখার চেষ্টা করেননি?
না, সে সময় আমার হয়নি।
প্রায় আশিতে এসেও এখনও আপনি রোম্যান্টিক রোলে অভিনয় করলেন ‘পুনশ্চ’ ছবিতে.....মনে পড়ে গেল ‘অপুর সংসার’য়ের কথা, ‘তিন ভুবনের পারে’...
তিনশোরও বেশি ছবিতে কাজ করা হয়ে গিয়েছে। এখন আর ও সব ভাবি না।
সত্যি ভাবেন না?
ভাবি কখনও কখনও। তার চেয়েও ভাবি বর্তমানের কথা। এ বছর আমি তিনটে ছবিতে কাজ করলাম যা করে আমি আনন্দ পেয়েছি। আশিতে এসে এত বিপরীতধর্মী চরিত্র পাওয়া সহজ নয়।
কী কী ছবি?
অমিতরঞ্জন বিশ্বাস পরিচালিত ‘ব্রিজ’। মনস্তাত্ত্বিক ছবি। শোভন তরফদারের ‘সেলফি’। ছবিটা একটা স্পুফ। কমেডিও বলা চলে। আর সুমন ঘোষের ‘পিস হাভ্ন’। একটা অন্য ধরনের ছবি। কাজ করে আনন্দ পেয়েছি। ভাল ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাই না বলেই তো খেদ। পেলে নিশ্চয়ই আনন্দ হয়। গত বছর ভর্গোনাথ ভট্টাচার্যের ছবি ‘যারা রোদ্দুরে ভিজেছিল’তে কাজ করেছি। গল্পটার মধ্যে বাঙালি জীবনের একটা সত্য আছে। তিনি রবীন্দ্রনাথ। আর রবীন্দ্রনাথ থাকলে আমার কাজ করার একটা উদ্দীপনা থাকেই। অবশ্যই যদি রবীন্দ্রনাথকে ঠিকঠাক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় তবেই।
এই বয়সেও কাজের এত উদ্দীপনা পান কোথা থেকে?
উদ্দীপনা তখনই পাই যখন দেখি আমার কাজের উপযোগী চিত্রনাট্য এবং চরিত্র পেলাম। অধিকাংশ বাংলা ছবিই তো এখন প্রায় তাধিনধিন বা ঢিসুম ঢিসুম।
তাধিনধিন কিংবা ঢিসুম ঢিসুম ছবিতে তো আপনিও অভিনয় করেছিলেন?
হ্যাঁ করেছি। অভিনয় করাটা আমার পেশা। কাজ না করে কি বসে থাকব?
কিন্তু এখন তো নিউ এজ বাংলা ছবির একটা আলাদা জায়গা হয়েছে।
নিউ এজ-টিউ এজ বুঝি না। কিছু পরিচালক আছে যারা বুদ্ধিদীপ্ত, মননশীল ছবি করে। তাদের কাছে কাজের সুযোগ পেলে ভাল লাগে। তবে এনার্জি লেভেল বলতে যেটা বোঝায় সেটা কিন্তু সত্যি আমার কমে গিয়েছে। চার ঘণ্টার বেশি একটানা কাজ করি না। ডাক্তারের নির্দেশ আছে, “যে দিন নাটক করবেন, সে দিন শ্যুটিং করা চলবে না।” কিন্তু সেটা সব সময় হয় না। কেউ হয়তো এসে বলল, ‘‘দাদা কাল ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সময় একটা শ্যুট আছে।” কেউ বা বলল,“বিকেলের আলোয় একটা শট নিতে হবে আপনাকে নিয়ে। না হলেই নয়।” কী করে ফেরাব তাঁদের?
সুমন ঘোষের ‘পিস হাভ্ন’ ছবির অনেকটা জুড়ে পরাবাস্তবের খেলা। চরিত্রটা আপনাকে আকর্ষণ করল কেন? বাস্তবতা কোথায়?
বাস্তব মানে তো রোজ চোখের সামনে যা দেখছি তা নয়। প্রত্যক্ষ দেখা ছাপিয়ে তারও বাইরে একটা বাস্তব থাকে। সুমনের এই ছবিটায় সেটা আছে। আসল কথা সুমনের চিন্তাভাবনার অভিনবত্ব আমার ভাল লাগে। নতুন ধারার ছবি অমিতরঞ্জন বিশ্বাসের ‘ব্রিজ’ও। এই ছবিতে আমি আর সন্ধ্যা মৃদুল দুটি ভিন্ন কারণে সুইসাইড করতে যাই। এবং আমাদের দেখা হয়ে যায়। খুব পজিটিভ গল্প। ছবির ট্রিটমেন্টও ভাল। অমিতরঞ্জনের নাটক ‘হোমাপাখি’ও আমি পরিচালনা করেছি। ও নিজে মনোচিকিৎসক। তাই ওর ছবির মানসিক টানাপড়েনের জায়গাগুলো খুব বাস্তব হয়। ‘ব্রিজ’ ছবিতেও সেটা আছে।
‘সেলফি’ ছবিতে অভিনয় করলেন। কখনও নিজে সেলফিতে ছবি তুলেছেন?
না। আগেই তো বললাম আমি এসব জানি না। এ ছবির মজাটা হল এই যে আমি এখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রেই অভিনয় করেছি।
আচ্ছা এত দিন ধরে অভিনয় করছেন সিনেমায়। আপনার আদর্শ কে? কিংবা রোল মডেল?
বলরাজ সাহানি। অসাধারণ। কী কী সব ছবিতে দুর্দান্ত-দুর্দান্ত সব অভিনয়। ‘ধরতি কে লাল’, ‘দো বিঘা জমিন’, ‘কাবুলিওয়ালা’। আমাদের বাঙালি অভিনেতাদের কারও কারও অভিনয় আমার ভাল লাগে। যেমন ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, যোগেশ চৌধুরী।
আর অমিতাভ বচ্চন?
ওর স্ক্রিন প্রেজেন্স ভাল, গলা ভাল। সেই সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা-বাক্স্ফূর্তি-ব্যক্তিত্ব চমৎকার। কিন্তু নাসিরুদ্দিনের অভিনয় আমার দারুণ লাগে। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যায়।
‘কাচকাটা হীরে’ বা ‘তিন ভুবনের পারে’ দেখলে কি মনে হয় যে আজকের যে সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁরা অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করছেন।
দেখুন এই সময় বছরে ৯৫ থেকে ১২০-টা ছবি হয়। তার মধ্যে জনা কয়েক পরিচালক হয়তো বুদ্ধিদীপ্ত ছবি করেন।
তাঁরা কারা?
আমি নাম বলতে পারব না। বলা উচিত হবে না। তা ছাড়া আর একটা কথা, নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের সঙ্গে পুরনো দিনের তুলনা হয় না। তখনকার দিনে সাহিত্য-নির্ভর ছবি হত বেশি।
এখনকার বাংলা ছবি দেখেন?
নতুন পরিচালকের ছবি বলতে ‘অটোগ্রাফ’, আর ‘জাতিস্মর’ দেখেছি। দেখেছি সৃজিতের সঙ্গে প্রসেনজিতের কেমিস্ট্রিটা ভাল বলে। ‘জাতিস্মর’ এই পর্যন্ত প্রসেনজিতের সব চেয়ে ভাল ছবি।
আজকাল এত নতুন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁরা কি আপনার সেরাটা আদায় করে নিতে পারছেন?
যে আমাকে ঠিকঠাক চিত্রনাট্য ও চরিত্র দিতে পারছে সে আমার সেরাটা আদায় করে নিচ্ছে। যেমন অতনু ঘোষ ‘অংশুমানের ছবি’, ‘রূপকথা নয়’ ছবিতে আমাকে খুব ভাল ভাবে ব্যবহার করেছিল।
আর ক’দিন বাদেই মুক্তি পাবে ভর্গোনাথ ভট্টাচার্যের ছবি ‘যারা রোদ্দুরে ভিজেছিল’, সেখানেও আপনি রবীন্দ্রনাথের...
হ্যাঁ, আমি একজন রবীন্দ্রচেতনার মানুষ এই ছবিতে। আমি নিজে যেহেতু বরাবরই রবীন্দ্র মননে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি সেই জন্য ‘যারা রোদ্দুরে ভিজেছিল’ ছবির চরিত্রটা আমায় আকর্ষণ করে। এমন একজন দাদুর চরিত্রে অভিনয় করছি যে তার নাতিকে রবীন্দ্রনাথে নিস্নাত করতে চায়। চরিত্রটার মধ্যে নানা ধরনের বৈপরীত্য আছে। আধুনিক জীবন সম্পর্কে তার কোনও সম্যক ধারণা নেই। এই বৈপরীত্য আছে বলেই চরিত্রটা আকর্ষণীয়।
কিছু দিন হল রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির পুরোটা পাঠ করেছেন। হঠাৎ এত বই থাকতে জীবনস্মৃতি পাঠ করলেন?
হ্যাঁ, ভাবনা রেকর্ডস-ক্যাসেট থেকে এটা করেছি। এর আগেও এই সংস্থার হয়েই আঠারোটা গল্প পড়েছিলাম ‘গল্পগুচ্ছ’ থেকে। জীবনস্মৃতি পড়লাম রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলে। ‘গল্পগুচ্ছ’র গল্পগুলো ছিল পারফরম্যান্স ভিত্তিক পাঠ। কিছুটা অভিনয়। কিন্তু জীবনস্মৃতি শুধুই পাঠ। এটা করলাম কারণ আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু বিভ্রম আছে। উনি স্কুল-পালানো ছেলে, লেখাপড়া শেখেননি স্কুলে গিয়ে। এগুলো হয়তো উনি করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন গৃহশিক্ষকের কাছে কাব্য, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস সবই অগাধ পড়েছেন। দশ এগারো বয়সে এমএ-এমএসসি পাস করার মতো জ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ছিল গ্রহীতার মন। যা পেতেন অন্তর দিয়ে শুষে নিতেন। আমি এখন আমার মেয়ে পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় গীতিনাট্য ‘কালমৃগয়া’ করছি। সেখানেও রবীন্দ্রনাথের আর এক স্রষ্টা মনকে তুলে ধরা হয়েছে নতুন ভাবে।
রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী পড়লেন। কিন্তু নিজে আত্মজীবনী লেখায় বিশ্বাস করেন না। কেন?
আত্মজীবনী লিখলে সত্যকথন হবে না। অনেককে বিব্রত করা হবে। আমার জীবনে যা কিছু আছে তা তো আমার কাজের মধ্যেই রয়ে গেল। আলাদা করে আত্মজীবনী লিখে কী হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy