Advertisement
E-Paper

নিরামিষ

ড্রাগ, সেক্স, স্ক্যান্ডাল সব নিয়েই খুল্লমখুল্লা আলোচনা করে বিদেশি তারকাদের জীবনী। কিন্তু এ দেশের তারকাদের নিয়ে লেখা বই যেন ন্যাতানো মুড়ি। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।দিলীপকুমারের আত্মজীবনী লেখার পরেও উদয়তারা নায়ারের একটা আফসোস রয়ে গিয়েছে। বইতে মধুবালা প্রসঙ্গ রয়েছে। কামিনী কৌশলের প্রতি দিলীপকুমারের আকর্ষণের কথাও রয়েছে। এমনকী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সায়রা বানু যে গর্ভস্থ পুত্রসন্তানকে হারান, সেটাও খুব যত্ন নিয়েই বলা আছে।

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০০:২০

দিলীপকুমারের আত্মজীবনী লেখার পরেও উদয়তারা নায়ারের একটা আফসোস রয়ে গিয়েছে। বইতে মধুবালা প্রসঙ্গ রয়েছে। কামিনী কৌশলের প্রতি দিলীপকুমারের আকর্ষণের কথাও রয়েছে। এমনকী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সায়রা বানু যে গর্ভস্থ পুত্রসন্তানকে হারান, সেটাও খুব যত্ন নিয়েই বলা আছে।

কিন্তু একটা এপিসোড একেবারেই প্রায় না ছুঁয়ে চলে গিয়েছে বইটা। তা হল দিলীপকুমারের দ্বিতীয় বিয়ে। মাত্র সাতটা প্যারাগ্রাফ! উদয়তারার দাবি, প্রচুর ফ্যান তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। কেন ওই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা এই বইয়ে মাত্র ৭-টা প্যারাগ্রাফে আটকে রাখা হয়েছে? “আমার হাতে থাকলে আমি দিলীপসাবের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনাটা দিয়ে একটা গোটা চ্যাপ্টার লিখতাম। কিন্তু লেখার সময় উনি আমাকে স্পষ্ট ভাবেই বলে দিয়েছিলেন যে যেটুকু উনি বলবেন, সেটাই লিখতে হবে। তার বেশি একটা কথাও নয়। অগত্যা আমাকে ওখানে থামতে হয়েছিল,” বললেন উদয়তারা। কী ভাবে দিলীপকুমারের সঙ্গে আসমা রহমানের দেখা হয়েছিল, কেনই বা বিয়ে করেছিলেন তিনি, তার পর ডিভোর্স ঠিক কী ভাবে হয়েছিল সে সবই পর্দানশিন হয়ে রয়েছে। “আমাকে বলেছিলেন আসমা হয়তো এখনও বেঁচে আছেন। এমন কিছু লিখতে চান না যা কাউকে আঘাত করে। আমি তা মেনে নিই,” লেখিকা জানান।

এই আঘাত না করার ভয়টাই কি ঠেলে দেয় আমাদের তারকা এবং লেখকদের এমন সব অ্যান্টিসেপটিকে ধোওয়া জীবনী লিখতে? সবাই মহান। কারও কোনও ত্রুটি নেই। যদি বা কোনও স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ উঁকি মারে, সেটাকে ছুঁয়েই চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। ঠিক যে ভাবে আগেকার দিনে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতেন।

যা প্রচারে আসে, তা অবশ্য বইয়ের প্ল্যানড পাবলিসিটিরই অংশ। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে কে নটবর সিংহের আত্মজীবনী। সেখানে তিনি লিখেছেন যে, রাহুল গাঁধীর কথা মেনেই না কি সনিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হননি। আর তার প্রেক্ষিতেই প্রণব মুখোপাধ্যায় কন্যা-শর্মিষ্ঠা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তাঁর বাবা কোনও দিন কিছু লিখবেন না। শর্মিষ্ঠার দাবি যে তাঁর বাবার মতে কিছু ব্যক্তিগত আলোচনা সবাইকে জানানো উচিত নয়। এ দিকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কন্যা দামন সিংহ লিখেছেন ‘স্ট্রিক্টলি পার্সোনাল: মনমোহন অ্যান্ড গুরশরণ’। সেখানে তিনি এমনটাও দাবি করেছেন যে কংগ্রেসের ভিতর থেকেও তাঁর বাবা অনেক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন! কিন্তু বইয়ে কোনও ব্যক্তিগত কেচ্ছা নিয়ে দামন আলোচনা করতে নারাজ।

নাসরিন মুন্নি কবীর, যিনি বেশ কয়েকজন তারকার সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতাকে বই হিসেবে প্রকাশ করেছেন, বলেন যে স্ক্যান্ডাল নিয়ে লিখতে তাঁর রুচিতে বাধে। এটা জেনেই কি তিনি ওয়াহিদা রহমানকে নিয়ে লেখা বইয়ে ওয়াহিদা-গুরু দত্ত রোম্যান্স নিয়ে কিছুই লেখেননি? লন্ডন থেকে এ প্রশ্নের উত্তরে নাসরিন বলেন, “আমি গসিপে ইন্টারেস্টেড নই। বরং জানতে চাই ওঁর অভিনয় নিয়ে।”

বিদেশে তারকাদের নিয়ে তো নানা মুখরোচক বইপত্রও বেরিয়েছে। প্রচুর লেখা পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়েছে চার্লি চ্যাপলিন নিজেই স্বীকার করে গিয়েছেন যে অন্তত ২০০০ তরুণীর সঙ্গে তাঁর যৌনসম্পর্ক ছিল! এমনটাও লেখা হয়েছে যে হলিউডে ‘কাস্টিং কাউচ’য়ের প্রবর্তক ছিলেন এই চার্লিই! অডিশনের সময় কী কাণ্ডই না করতেন চ্যাপলিন। নির্বাক ছবির যুগ। অডিশন করতে গিয়ে তিনি ক্যাপশন কার্ড ব্যবহার করতেন। যেগুলো আস্তে আস্তে খুব অর্থবহ হয়ে উঠত। তার পর না কি শুরু হত চ্যাপলিনের অদ্ভুত সব যৌন আচরণ! এ সব বিতর্কিত বিষয় নিয়ে নানা ধরনের লেখালিখি হয়েছে।

শুধু চ্যাপলিন নন, লেডি ডায়ানার জীবনীতেও অনেক বিতর্কিত কথা লেখা ছিল। অ্যান্ড্রু মর্টনের লেখা ‘ডায়ানা: দ্য ট্রু স্টোরি’তে ডায়ানার বুলিমিয়া রোগ থেকে শুরু করে তাঁর আত্মহত্যার প্রচেষ্টা এবং অ্যাফেয়ার সব নিয়েই লেখা ছিল। প্রিসিলা প্রেসলে তো তাঁর ‘এলভিস অ্যান্ড মি প্রিসিলা প্রেসলে’ আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন তিনি চুলের কী রং করবেন থেকে কী খাবার খাবেন সব কিছু এলভিস ঠিক করে দিতেন। আন্দ্রে আগাসির আত্মজীবনী ‘ওপেন’য়ে লিখেছিলেন যে তাঁর বাবা এতটাই রেগে যেতেন যে প্রথম বার স্টেফি গ্রাফের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় তাঁদের হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল। জিমি কনর্স তাঁর জীবনী ‘দ্য আউটসাইডার’য়ে লিখেছিলেন কী ভাবে ক্রিস এভার্টের সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে তাঁকে অন্তঃসত্ত্বা করে ফেলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ক্রিস অ্যাবর্শন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘ইটি’ ছবির নায়িকা ড্রু ব্যারিমোর তো মাত্র ১৫ বছর বয়সে লিখে ফেলেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী। ন’বছর বয়সে প্রথম মদ খান। ড্রাগ নেন ১০ বছর বয়সে। ১২ বছর বয়সে খান কোকেন। গত বছর সামান্থা গিমার লিখেছিলেন তাঁর বিতর্কিত আত্মজীবনী। নাম ‘গার্ল: আ লাইফ ইন দ্য শ্যাডো অব রোমান পোলানস্কি’। কিংবদন্তি পরিচালক যখন তাঁর সঙ্গে যৌনসম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তখন সামান্থা তেরো। পোলানস্কি তেতাল্লিশ। যৌনমিলন হয়েছিল না কি জ্যাক নিকলসনের ফাঁকা বাড়ির জাকুজিতে!

বিদেশি প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য জীবনীগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের তারকাদের আত্মজীবনীগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরামিষ। কিছু অপ্রামাণ্য জীবনী লেখা হয়েছে ঠিকই। যেমন মোহনদীপের লেখা রেখা, মধুবালা এবং মীনাকুমারীর জীবনী। কিন্তু মধুবালার বোন তা দেখে রেগে গিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন। “আমিও তার জবাব দিয়েছিলাম। মীনাকুমারীর ফ্যানেরা মারাত্মক খেপেছিল। কারণ? লিখেছিলাম উনি মদ খেয়ে অ্যাওয়ার্ড নিতে গিয়েছিলেন। ওঁর ‘টয় বয়’ ছবিও ছেপে দিয়েছিলাম,” মোহন জানান।

রেখার ক্ষেত্রে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। মোহনের কথায়, “লন্ডনে শপ লিফটিং থেকে সুইসাইড করার চেষ্টা সব ছিল রেখার ওই জীবনীতে। প্রশংসাও কম হয়নি। খোদ খুশবন্ত সিংহের মতো লেখকের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছি। তবে বলিউডের পিআর জার্নালিস্ট বা যারা কোনও ক্যাম্পে থাকে, তাদের আমার লেখা সহ্য হয় না।”

‘গাঁধী... মাই ফাদার’ ছবির পরিচালক ফিরোজ আব্বাস খান মনে করেন যে মহাপুরুষদের মধ্যে গাঁধীজি একমাত্র উদাহরণ তৈরি করে গিয়েছেন বেশ কিছু বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আত্মজীবনী লিখে। “যৌনতা নিয়েও তিনি লিখেছেন। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে এই রকম উন্মুক্ততা দেখা যায় না। আমাদের দেশে সামাজিক লজ্জার ব্যাপারটা খুব পীড়াদায়ক,” বলছেন ফিরোজ। আরও জানাচ্ছেন যে ইদানীং যে রাজনৈতিক আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে লেখা। “পুরোটাই একটা ব্যবসা। সরকারে থাকাকালীন যাঁরা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন, কোনও প্রতিবাদ করেননি, তাঁরাই আজকাল আত্মজীবনীতে কত কী বলেছেন! আর এই জীবনীর ব্যবসায় সব থেকে বড় ক্ষতিটা হয় সত্যের। তা সে সঞ্জয় বড়ুয়া হোক কী কে নটবর সিংহ,” বলছেন ফিরোজ।

তবে বিনোদনের জগতে এই দেশে এই রকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জীবনী লেখার অভিযোগ এখনও ওঠেনি। সেখানে ঝামেলাটা অন্য। নাসরিনের ধারণা এই দেশের স্বনামধন্যেরা অনেক বেশি সতর্ক তাঁদের নিয়ে লেখা বইয়ে কী ধরনের ‘কোট’ ব্যবহার হচ্ছে তা নিয়ে। “এক জন তারকা কিছু বললেই সেটা ভারতে ফ্রন্ট পেজ নিউজ হয়ে যায়। টেলিভিশন চ্যানেলে চ্যানেলে সেটা নিয়ে খবর হয়। কিন্তু বিদেশে বিনোদনের তারকাদের ক্ষেত্রে তা হয় না।”

নন্দিতা পুরী তাঁর স্বামী ওম পুরীর জীবনী লিখে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মতে এ দেশের তারকাদের বিতর্কিত অতীত নিয়ে লেখার সব চেয়ে বড় সমস্যা হল সমাজের ভণ্ডামি। “সত্যিটা যদি নাই লেখা যায় তা হলে জীবনী লেখার মানে কী?” পাল্টা প্রশ্ন নন্দিতার। কিন্তু তাঁর কলমে লেখা ওমের জীবনীর জন্যই তো বিয়েটা ভাঙতে বসেছে বলে অনেকের ধারণা। “একদম নয়। যা হওয়ার তা হতই। বইয়ের জন্য কিছুই হয়নি। সব কিছু রেকর্ড করা আছে। ওমের যদি সত্যি আপত্তি থাকত ও আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেনি কেন? আসলে ব্যাপার হল আমরা চেষ্টা করি জীবনের মধ্যে দিয়ে তারকাদের ভগবান হিসেবে প্রেজেন্ট করতে। কিন্তু বিদেশে এমনটা হয় না,” বলছেন নন্দিতা। ওমের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার পরেও নন্দিতার ইচ্ছে আরও জীবনীগ্রন্থ লেখার। “সঞ্জয় দত্তের জীবনীটা লিখতে পারলে বেশ হয়,” জানাচ্ছেন নন্দিতা।

উদয়তারার মতে ভবিষ্যতের জীবনীগুলোতে অভিনেতাদের লাভ চাইল্ড থেকে অ্যাডিকশন সবিস্তার আলোচিত হবে। তিনি এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, সেই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেব আনন্দ তাঁর আত্মজীবনীতে বেশ খোলাখুলি কথা বলেছিলেন। “জানি না জিনাত আমন যদি দেব-পর্ব নিয়ে লেখেন তা হলে কী করবেন। বৈজয়ন্তীমালা বালি তাঁর আত্মজীবনীতে রাজ কপূরের সঙ্গে অ্যাফেয়ারের ব্যাপারটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওটা ছিল পাবলিসিটি স্টান্ট। তা দেখে বেজায় চটে যান ঋষি কপূর। প্রতিবাদে নিজের বাবার অ্যাফেয়ার নিয়ে মুখ খোলেন। আশা করছি বলিউডের নতুন তারকারা সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠবেন,” বলছেন উদয়তারা।

দিলীপকুমারের বইটির পর উদয়তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অন্য এক কাজে। বলিউডের সুন্দর দিকটা নিয়ে তো অনেক লেখালিখি হয়েছে। এ বার কদর্য দিক নিয়ে লিখছেন তিনি। আলাদা করে কারও জীবনী নয়। ড্রাগস, সেক্স, স্ক্যান্ডাল হয়তো সব থাকবে সেখানে। মুখোশ ছিঁড়ে অনেক তারকার সত্যিটা প্রকাশ করার স্বপ্ন এখন তাঁর চোখে।

biographies autobiographies celebrities india priyanka dasgupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy