Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মঞ্চের অর্ধেক আকাশ শিপ্রা-সোহিনীরা

স্ত্রী নাদিরা, প্রেমিকা রানাদিল আর দুই বোন জাহানারা, রোশেনারার মাঝে বারংবার ঘুরপাক খেয়েছে সে। শেষ অবধি বলতে বাধ্যও হয়, জাহানারা ছাড়া আর কেউ বোঝেনি তাকে। শাহজাদা দারাশুকোকেও নারীর কাছে নতজানু হতে হয়! শ্রীজাতর লেখা ‘কর্কটক্রান্তির দেশে’ আজ, শুক্রবার ঋত্বিকের নাট্যমেলার আকর্ষণ। মূল ধারার ইতিহাস শাহজাহান, দারা, ঔরংজেবদের কথা লেখে। কিন্তু রানাদিলরা ফুটনোট হয়েই থাকেন। আর ‘স্বপ্নসন্ধানী’-র আজকের নাটকে কৌশিক-ঘরণী রেশমি সেন মঞ্চে নেই। নাটকের পোশাক পরিকল্পনা তাঁরই।

 বৃহস্পতিবার নাটক শুরুর ঠিক আগে নির্দেশকের সামনে ‘শূদ্রক’-এর শিল্পীরা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

বৃহস্পতিবার নাটক শুরুর ঠিক আগে নির্দেশকের সামনে ‘শূদ্রক’-এর শিল্পীরা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০৯
Share: Save:

স্ত্রী নাদিরা, প্রেমিকা রানাদিল আর দুই বোন জাহানারা, রোশেনারার মাঝে বারংবার ঘুরপাক খেয়েছে সে। শেষ অবধি বলতে বাধ্যও হয়, জাহানারা ছাড়া আর কেউ বোঝেনি তাকে। শাহজাদা দারাশুকোকেও নারীর কাছে নতজানু হতে হয়! শ্রীজাতর লেখা ‘কর্কটক্রান্তির দেশে’ আজ, শুক্রবার ঋত্বিকের নাট্যমেলার আকর্ষণ।

মূল ধারার ইতিহাস শাহজাহান, দারা, ঔরংজেবদের কথা লেখে। কিন্তু রানাদিলরা ফুটনোট হয়েই থাকেন। আর ‘স্বপ্নসন্ধানী’-র আজকের নাটকে কৌশিক-ঘরণী রেশমি সেন মঞ্চে নেই। নাটকের পোশাক পরিকল্পনা তাঁরই। মেয়েরা শুধু অভিনেত্রী হয়েই থাকেন না। বহু ভাবে নাটককে এগিয়ে নিয়ে যান।

এই সত্য বোঝা যাচ্ছে বহরমপুরে ঋত্বিকের নাট্য উৎসবে। ১৩টি নাটকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, তিনটি নাটকেই পরিচালক মেয়েরা। এই পরিসংখ্যান কলকাতার নাট্য উৎসবগুলিতেও নেই।

তিন নারীর মধ্যে কলকাতার সোহিনী সেনগুপ্ত, অবন্তী চক্রবর্তী আছেন। আছেন রবীন্দ্রনাথের ‘কঙ্কাল’ অবলম্বনে ঋত্বিক গোষ্ঠীর একাঙ্ক নাটকের পরিচালক শিপ্রা সেন। “অভিনয়টাই করতাম। কিন্তু গত বিশ্ব নারী দিবসের অনুষ্ঠানে নাটক পরিচালনার জন্য দলই আমাকে সামনে ঠেলে দিল,” বলছিলেন শিপ্রা। ঋত্বিক-সম্পাদক মোহিতবন্ধু অধিকারী হাসলেন, “পঁয়ত্রিশ বছরের দল। এখনও যদি মহিলারা পরিচালনায় এগিয়ে না আসেন, হয়?” কলকাতায় অনেক এনজিও-ই হরবখত বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে গরু এবং নারী পাচারের পরিসংখ্যান দেন। কিন্তু অন্ধকারের নীচে বহরমপুর নাট্যদুনিয়ার অর্ধেক আকাশে আলোর দ্যোতনা তাঁরা খেয়াল করেন না।

শুধু শিপ্রা নন। যুগাগ্নি নাট্যদলে কখনও পরিচালনার দায়িত্বে: সীমা সরকার। রঙ্গাশ্রম নাট্যদলেও ৯জন মহিলা মঞ্চে এবং নেপথ্যে সক্রিয়। পুরুষশাসিত মফস্সলি সমাজে নাটক পরিচালনা কতটা গুরুভার? শিপ্রা হাসলেন, “এতটুকু নয়। আমার স্বামী এই ঋত্বিক দলে, ফলে তিনিই অন্যতম উৎসাহদাতা।” তবে নান্দীকারের সোহিনী সেনগুপ্তের মতো তাঁরও বক্তব্য, “পরিচালনা দায়ে পড়ে। অভিনয়-ই প্রথম প্রেম।”

এমনটাই তো হওয়ার কথা! বাংলা সিনেমায় অরুন্ধতী দেবী, অপর্ণা সেনেরও আগে যে মহিলা প্রথম অভিনয় এবং পরিচালনা দুয়েতেই ছাপ ফেলেছিলেন, তিনি বহরমপুরের কন্যা: মঞ্জু দে। তাঁর পরিচালিত ‘অভিশপ্ত চম্বল’ বহুখ্যাত, এমনকী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ-কাহিনি নিয়ে প্রথম ছবি পরিচালনা করছিলেন তিনিই: ‘শজারুর কাঁটা’। অঞ্জন দত্ত, দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়দের যুগে সবাই সেই বহরমপুর-কন্যাকে ভুলে গিয়েছে। সাধে আত্মবিস্মৃত জাতি হিসেবে বাঙালি ভারতখ্যাত!

বহরমপুরের মেয়েদের এই উত্থান হাল আমলের শৌখিন, শহুরে নারীবাদের হাতফেরতা উত্তরাধিকার নয়। ইতিহাস-গবেষক সায়ন্তন মজুমদার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯২০/২১ সালে ডোমকল মহকুমার ভগীরথপুরে চৌধুরীবাড়ির অলকা চৌধুরী, সবিতা চৌধুরী প্রমুখ গৃহিণীরা তাঁদের বাড়ির নাটকে অভিনয় করেছিলেন। মফস্সলের জমিদার- বাড়ির বউদের এই অভিনয় ইতিহাস মনে রাখেনি।

উচ্চবর্গের পাশাপাশি নিম্নবর্গের সংস্কৃতিতেও আছে উজ্জ্বল উদ্ধার। এখানকার আলকাপ গানে মেয়েরা থাকত না। আলকাপ-গবেষক সৈয়দ খালেদ নৌমানের স্মৃতি: সত্তরের গোড়ায় মেয়েরা প্রথম আলকাপ গাইতে শুরু করেন। জঙ্গিপুরের ঝাকসু তাঁর দুই মেয়ে মীরা ও চিনিকে তখন আলকাপ গাইতে নিয়ে যেতেন। নৌমান সাহেবের দাদাও ঝাকসুর দলে গাইতেন, সাহিত্যিক হিসাবে বিখ্যাত তিনি: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ!

নাটক, ইতিহাস এবং নতুন নারী এই এলাকায় একত্র মিশে। আজও এখানে অন্যতম ট্যুরিস্ট-অ্যাট্রাকশন: ভাগীরথীর তীরে সিরাজ ও তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসার কবর। ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিক বইতে দেখিয়েছেন, লুৎফার খোঁজখবর বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেও কেউ জানত না। তিরিশের দশকে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়ে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদদৌল্লা’ নাটকের পরই ওই চরিত্র জনগণমনে গেঁথে যায়। নাটকের পাতা থেকে নারীর ‘ইতিহাস’ হয়ে ওঠা এই বহরমপুর, মুর্শিদাবাদেই ঘটে থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE