Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শীত উপেক্ষা করে দর্শকের ভিড়, জমজমাট কল্যাণীর নাট্য উত্‌সব

এক ডজন নাটক। বহুরূপী, নান্দীকার, স্বপ্নসন্ধানী, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, ন’য়ে নাটুয়ার মতো এ সময়ের সেরা সব নাট্যদল। দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, কৌশিক সেন, দেবেশ রায়চৌধুরী, সীমা মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর চক্রবর্তী, শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তাবড় সব তারকা অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয়। মঞ্চস্থ হল রবীন্দ্রনাথ থেকে সুকুমার রায়, অ্যালবেয়ার কামু থেকে ব্রেশট, নাটককারদের তালিকাও চোখ ধাঁধানো। এ যেন শীতসন্ধ্যায় সমকালীন বাংলা নাটকের মহাভোজ।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
কল্যাণী শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:১৮
Share: Save:

এক ডজন নাটক। বহুরূপী, নান্দীকার, স্বপ্নসন্ধানী, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, ন’য়ে নাটুয়ার মতো এ সময়ের সেরা সব নাট্যদল। দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, সোহিনী সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, কৌশিক সেন, দেবেশ রায়চৌধুরী, সীমা মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর চক্রবর্তী, শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো তাবড় সব তারকা অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয়। মঞ্চস্থ হল রবীন্দ্রনাথ থেকে সুকুমার রায়, অ্যালবেয়ার কামু থেকে ব্রেশট, নাটককারদের তালিকাও চোখ ধাঁধানো। এ যেন শীতসন্ধ্যায় সমকালীন বাংলা নাটকের মহাভোজ। কেবল একটু সময় বের করে মন আর মনন দিয়ে দেখতে হবে। নাট্য রসিকের সঞ্চয়ের ভাঁড়ার তাতেই উপচে পড়বে। নাটকের নতুন মরসুম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে এই একটি উত্‌সবই যথেষ্ট।

কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র তাদের নাট্য উত্‌সবের কুড়িতম বছরটি খালেদ চৌধুরির স্মৃতিতে উত্‌সর্গ করেছেন। বিশতম নাট্য উত্‌সবে উদ্যোক্তাদের ঘোষণা ছিল‘কিছুই কোথাও যদি নেই, তবু তো ক’জন আছি বাকি, আয় আরও হাতে হাত রেখে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’ সেই বাকি থাকা ক’জনের হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকতে চেয়ে ওঁরা উত্‌সবে কলকাতার নামী দলের পাশেই রেখেছেন মফস্‌সলের নাট্যদলগুলিকে। আবার তারকা অভিনেতার সঙ্গেই উত্‌সব মঞ্চে ডাক পেয়েছেন সম্ভাবনাময় নবীন অভিনেতারাও। কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের কুড়িতম নাট্য মেলায় ঠাই পাওয়া এক ডজন নাটক আসলে যত্ন করে বেছে আনা বাংলা নাটকের চলতি সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রযোজনাগুলিকে। উদ্যোক্তাদের বাছাই করা ওই এক ডজন নাটক দেখলেই সামগ্রিক ভাবে এই সময়ের বাংলা নাটকে সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা গড়ে উঠবে।

১৭ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ডিসেম্বর কল্যাণীর ঋত্বিক সদনে অনুষ্ঠিত হয়েছে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের সেই বিশতম নাট্য উত্‌সব। উদ্বোধনী সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয়েছে নিভা আর্টসের ‘গ্যালিলেও গ্যালিলেই’। অন্ধকার সময়ে জন্ম নেন এক মানুষ যার হাতে দূরবীন। মানুষটি সত্যদর্শী, তাই ক্ষমতাহীন সুতরাং হননযোগ্য। প্রাণভয়ে তিনি বাধ্য হন সত্য অস্বীকারে। তারপর আমৃত্যু অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে শেষে সত্যকেই পুনরুদ্ধার করে গোপনে লেখেন ‘ডিসকোর্সি’। তিনি গ্যালিলেও গ্যালিলেই। মূল রচনা ব্রেশট। অনুবাদ রতন কুমার দাস। নির্দেশনা বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়।

দ্বিতীয় সন্ধ্যায় ছিল উদয়ন প্রযোজিত ‘সিরাজদ্দৌলা’। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের নাটক। নির্দেশনা মানব রায়। বাংলার অকুতোভয় দেশপ্রেমী শেষ স্বাধীন নবাবকে ভয় পেতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা। যিনি মনে করতেন দেশপ্রেম কেবল এক চিলতে জমিকে ভালোবাসা নয়। তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা সব মানুষকে ভালোবাসাই দেশপ্রেম। বিশ্বাসঘাতক পার্শ্বচরেদের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করে ব্রিটিশরা এদেশে আধিপত্য বিস্তার করে।

তৃতীয় সন্ধ্যায় ছিল নয়ে নাটুয়া প্রযোজিত ‘হাওয়াই’। এভাল্ড ফ্লিশারের কাহিনী অবলম্বনে রতনকুমার দাসের অনুবাদ করা নাটকটির সম্পাদনা, নির্দেশনা এবং অভিনয়ে ছিলেন গৌতম হালদার। এই নাটক তিন পাগলের গল্প। যারা পেটে খিদে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, ভালবাসে, প্রেম করে আবার মজা করে অফুরন্ত। এই পাগলেরা বিশ্বাস করে শুধুমাত্র তারাই সুস্থ মানুষ যাদের হৃদয় অন্তর পরিপূর্ণ ভালোবাসায়, স্নেহে আর মায়ায়।

চতুর্থ দিন শনিবার স্বপ্নসন্ধানীর নাটক কর্কটক্রান্তির দেশের পরপর দু’টি শো হয়। শাজাহানের সবচেয়ে বিদ্বান, সভ্য এবং সংস্কৃতিবান সন্তান ছিলেন দারাশুকো। সম্রাটেরও প্রিয় ছিলেন। অথচ তাঁকেই ইসলামের শত্রু বলে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ঔরংজেব। এই ঘটনা সপ্তদশ শতাব্দীর ভারতবর্ষকে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ইতিহাসের পণ্ডিতেরা বলেন দারাশুকোর হাতে মোঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতা গেলে ভারতে ইতিহাস হত অন্যরকম। দারার সঙ্গে সঙ্গে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত্‌কে হত্যা করেন ঔরংজেব। নাটককার এখানে ক্ষমতার ইতিহাসকে প্রশ্ন করেছেন। নাটক শ্রীজাত, নির্দেশনা, অভিনয়ে কৌশিক সেন।

রবিবার ছিল দু’টি নাটক। প্রথম নাটক ইচ্ছে মতো প্রযোজিত ‘বুদ্ধিজীবী’। সৌরভ পালোধী নির্দেশিত এ নাটক সব কিছুর সঙ্গে সমঝোতা করে বেঁচে থাকা মানুষকে নিয়ে। যে প্রতিবাদ করার ছিল তা করা হয় না, ঠোঁটের আগায় ঝুলে থাকা অপ্রিয় প্রশ্ন গিলে নিয়ে আমরা ভাবি, কী দরকার ঝুট ঝামেলায় যাওয়ার। কিন্তু যখন আমার বিপদ ঘনিয়ে আসে তখন এক দল বুদ্ধিজীবী উদয় হয়। সঙ্কট মুক্তির দিশা দেখাতে যাদের নিজেদের সংশয়ে দীর্ণ চেহারাটা বেরিয়ে আসে। এ দিনের দ্বিতীয় নাটক ছিল কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নিজস্ব প্রযোজনা। দলের তরফে কিশোর সেনগুপ্ত বলেন, আমরা এবার ‘ফিরে দেখি একবার বারবার’ নামে একটি থিয়েটার রেট্রোস্পেক্টিভ বিভাগ রেখেছিলাম। তাতে আমাদের তিনটি পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ করেছি। রবিবার ছিল সেই বিভাগের প্রথম নাটক ‘তৃতীয় আরেক জন’। নাটক সমীর দাশগুপ্ত, নির্দেশনা কিশোর সেনগুপ্ত।

সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, উত্‌সবের ষষ্ঠ সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয় সায়কের ‘দামিনী হে।’ কাহিনী অমর মিত্র, নাটক চন্দন সেন, নির্দেশনা মেঘনাদ ভট্টাচার্য। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র দামিনী লৌকিক অলৌকিকে মেশানো এক আশ্চর্য চরিত্র। অসামান্য বুদ্ধিমত্তা আর অসম সাহসে যে একই সঙ্গে আগলে রাখে নিজেকে এবং একদল বৃদ্ধকে। মনে মনে সে লালন করে একটাই স্বপ্ন। একদিন তার গর্ভে আসবে একটি প্রাণ, যে মুক্তি দেবে অসংখ্য শৃঙ্খলিত প্রাণকে।

মঙ্গলবার নাট্যোত্‌সবের সপ্তম সন্ধ্যা নবারুণ ভট্টাচার্য অনুদিত ম্যাক্স ফ্রিশের নাটক ‘যারা আগুন লাগায়’ মঞ্চস্থ করে তৃতীয় সূত্র। সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত এ নাটক এমন মানুষকে নিয়ে, অন্যের ঘরে আগুন লাগানোই যার কাজ। বুধবার ছিল থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাটক ‘বিয়ে গাউনি কাঁদন চাঁপা’। মুসলমান সমাজে বিয়ের গান যাঁরা গেয়ে থাকেন তাঁদের বলা হয় বিয়ে গাউনি। উচ্চশিক্ষিতা বধূ মানোয়ারা তাঁর শাশুড়ির মুখে বিয়ে গাউনিদের গান শুনে বেরিয়ে পড়েন তাঁদের সন্ধানে। বর্ধমানের গোলবিবি, মুর্শিদাবাদের সালারের ফেলনা বিবি, ওলেমাদের লড়াই দেখে তিনি চমকে যান। জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট-কান্নাকে চাপা দিয়ে তাঁরা উত্‌সবের গান গেয়ে চলেন। তাই তাঁরা কাঁদন চাঁপা। রত্না রশিদের গবেষণা থেকে এই নাটক নির্মাণ করেছেন চন্দন সেন। নির্দেশনা অশোক মুখোপাধ্যায়।

২৫ ডিসেম্বর, বড়দিনে ছিল দুটি নাটক। বিকেল তিনটে থেকে ছিল ঋত্বিকের প্রযোজনায় আবু হোসেন। নাটক বাদল সরকার। নাচগানে ভরা এক ঘণ্টার এই নাটকের মূল আধার হল লোকজ বোলান গান। এই সময়ের বোলান গানের সঙ্গেই ছিল লুপ্ত প্রায় লোকনাট্য লেটোর আঙ্গিক। রাঢ় বঙ্গের লোকগান এবং লোকনৃত্য আধারিত আবু হসেন সব বয়সের দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। এ দিনের দ্বিতীয় নাটক ছিল উদ্যোক্তা সংস্থার ‘ফিরে দেখি একবার, বারবার’ পর্বের দ্বিতীয় নিবেদন ‘হারিয়ে যায় মানুষ’। এটি কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের ২০১২ সালের অত্যন্ত সফল প্রযোজনা। মূল রচনা অ্যালবেয়ার। অনুবাদ হেনরি জোনস-কাবেরি বসু। রূপান্তর ও নির্দেশনা কিশোর সেনগুপ্ত।

২৬ ডিসেম্বর ছিল বহুরূপী প্রযোজিত নাটক ‘মুখোশের মুখ’। নাটক অরূপ শঙ্কর মৈত্র, নির্দেশনা দেবেশ রায় চৌধুরি। শুধু মানুষের বহিরঙ্গ নয়, অন্তরের চিন্তা ভাবনার ছবিও উঠে আসে এমন এক অত্যাধুনিক ক্যামেরা নিয়ে ফুলডিংলার আদিবাসী গ্রামের লাগোয়া মাইন কোম্পানির বড় চাকুরে ভাগ্নির আবাসনে আসেন ফোটোগ্রাফার মামা। তাঁর তোলা ছবিতে বেরিয়ে আসে খনিতে কর্মরত আদিবাসীদের আসল মুখগুলো।

২৭ তারিখ শনিবারও প্রদর্শিত হয় দুটি নাটক। বিকেলে হাতেখড়ি প্রযোজিত নাটক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যে নাটকের পরিচয় লিপিতে লেখা হয়েছে বাংলার শেষ নান্দনিক স্বেচ্ছাচার। নাটককার চিরঞ্জীব বসু। নির্দেশনা দেবাশিস ঘোষ দস্তিদার। এ দিন সন্ধ্যা ৬.৪৫ থেকে ছিল ‘ফিরে দেখি একবার, বারবার’ পর্বের তৃতীয় নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোড়ায় গলদ। সম্পাদনা অরুণ মুখোপাধ্যায়। নির্দেশনা কিশোর সেনগুপ্ত।

২৮ ডিসেম্বর রবিবার উত্‌সবের শেষ দিনে নাটক শুরু হয় সকাল সাড়ে দশটা থেকে। ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ মঞ্চস্থ করে শিল্পী সঙ্ঘ। সুকুমার রায়ের তিনটি ছোট গল্প দ্রিঘাংচু, রাজার অসুখ, পাজি পিটার এবং ছড়া গন্ধবিচার, নেড়া বেলতলায় কবার যায় ও বোম্বা গড়ের রাজা এই সবগুলোকে মিলিয়ে নাটক নির্মাণ করেছেন চঞ্চল ভট্টাচার্য। নির্দেশনা সীমা মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যায় পরপর দুটি নাটক নান্দীকার প্রযোজিত। প্রথমে ‘অন্ত আদি অন্ত’। মূল কাহিনী মার্গরিত দুরার, রূপান্তর রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। নির্দেশনা দেবশংকর হালদার।

শেষ দিনের ছিল ‘বিপন্নতা’। নাটক দেবতোষ দাস। নির্দেশনা সোহিনী সেনগুপ্ত। রোজ উপচে পড়া হল, একটি টিকিটের জন্য হাহাকার, শীতের গভীর রাতে নাটক দেখে বিশ পঞ্চাশ কিমি দূরে বাড়ি ফেরা-- এ সবই ভাল নাটকের অনুপ্রেরণা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE