Advertisement
E-Paper

শহরে কাজের খোঁজে

নাম নয়নচাঁপা। বাড়ি ক্যানিং। চায়ের দোকান থেকে বাবুদের হাউজিং। বুধবার দুপুরে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার ‘যন্ত্রণা’ কাছ থেকে দেখলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।নাম নয়নচাঁপা। বাড়ি ক্যানিং। চায়ের দোকান থেকে বাবুদের হাউজিং। বুধবার দুপুরে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার ‘যন্ত্রণা’ কাছ থেকে দেখলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০০

দুপুর ৩.৩০

যাদবপুর কানেক্টর। চায়ের দোকান। এক বৃদ্ধা মহিলা নানা ধরনের বিস্কুট সাজিয়ে বসা। নীল সালোয়ার কামিজ পরা অল্পবয়েসি মেয়ে এসে বললেন, “ও দিদি, এদিকে শুনবেন? কাজ খুঁজছি। কোথায় যাব বলুন তো?” বৃদ্ধা তাঁর অন্যান্য খদ্দেরদের নিয়ে ব্যস্ত। মোটেও পাত্তা দিলেন না মেয়েটি বা তাঁর মধ্যবয়স্ক সঙ্গিনীকে। পরনে ছাপা শাড়ি। মাথায় টেনে খোঁপা। পায়ে হাওয়াই চপ্পল। কোলে এক শিশু।

বৃদ্ধা উত্তর না দিলে কী হবে, ওঁরা হাল ছাড়ার পাত্রী নন। “কোন বাড়িতে যাব বলে দিন না?” বার তিনেক একই প্রশ্ন করাতে বিরক্ত হয়ে শেষে বৃদ্ধা বলেন, “অত সহজে কি কাজ পাওয়া যায়? ভোটার কার্ড লাগবে, ফোটো লাগবে, তবে না হবে? ইচ্ছে হল আর চলে এল কাজ খুঁজতে!” পাশ থেকে মধ্যবয়সি মহিলা তখন মুখের ঘোমটা সরিয়ে বলেন, “আচ্ছা, আধার কার্ড আছে। হবে?” এ বার বৃদ্ধা আরও রেগে গেলেন। গলার স্বর উঁচিয়ে বললেন, “ও সব হবে না বলে দিলুম। ভোটার কার্ড চাই। যাও, আমাকে আর বিরক্ত কোরো না। ব্যবসার সময়, আর আমি নাকি ওদের কাজ খুঁজে দেব। চাইলে ওই সাদা বিল্ডিংগুলোতে যাও। দেখো, যদি কেউ ঢুকতে দেয়।”

দোকান থেকে বেরিয়ে দুই মহিলা হনহন করে হাঁটা শুরু করেন গাড়ির দিকে। বৃদ্ধা তাতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। নতুন খদ্দেরকে লাল চা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যে ভাবে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বকুনি দিলেন, তাতে মনেই হল না দুই অভিনেত্রীকে তিনি চিনতে পেরেছেন। এ যাত্রায় ভোটার কার্ড থাকলে হয়তো কাজের সন্ধান দিয়েই দিতেন।

কারা এই দুই অভিনেত্রী?

একজন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। অন্য জন শেখর দাশের ‘নয়নচাঁপার দিনরাত্রি’তে তাঁর সহ-অভিনেত্রী দামিনী বসু। মঙ্গলবার রাত পৌনে বারোটার সময় জন্মদিনের কেক কেটেছিলেন রূপা। তবে সেলিব্রেশন বাড়িতে নয়। দিল্লিতে এক হিন্দি সিরিয়ালের শ্যুটিং করতে করতে। তার পর রাত আড়াইটে অবধি একটা মিটিং। বুধবার সকাল আটটার মধ্যে এয়ারপোর্টে তিনি। ফ্লাইট ধরে সোজা কলকাতা। গল্ফ গার্ডেনের বাড়িতে ফিরেই শুরু হল অন্য এক প্রস্তুতি। মাত্র বারো ঘণ্টার তফাতে শুধুমাত্র আনন্দ প্লাস-এর জন্য রূপা হয়ে গেলেন ভুলুর মা—নয়নচাঁপা। কাজ খুঁজতে বেরোলেন বাইপাসের ধারে। প্রথম স্টপ চায়ের দোকান। তার পর আবার যাত্রা শুরু।

দুপুর ৩.৪৫

গাড়ি ধেয়ে চলে বাইপাস দিয়ে। রুবি কানেক্টরের কাছে গিয়ে জ্যামে আটকে গেল। বাদামওয়ালা, বেলুনওয়ালার গাড়ির পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। স্করপিও গাড়ির সামনের সিটে ও রকম বেশে এক মহিলাকে দেখে কেমন সন্দেহের চোখে তাকালেন বাদামওয়ালাটি। খানিকটা ভয়ে আর কিছুটা সন্দেহের বশেই হয়তো একবারও রূপাকে বাদাম কিনতে বললেন না। “বুঝলে রূপাদি, তোমাকে দেখে ওদের খুব একটা সুবিধের লাগল না। তাই লোকটা একবারও বাদাম কিনতে বলল না!” বলেন দামিনী।

রূপার মুখে হাসি। প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছিল মেক আপ দিয়ে গায়ের রংটা শ্যামবর্ণ করতে। কে বলবে, এই সেই রূপা যিনি ১২ ঘণ্টা আগে ‘খামোশ কা অফসানা’ হিন্দি সিরিয়ালে অভিনয় করে এসেছেন এক মূক মহিলার চরিত্রে! বুধবার দুপুরে তাঁরই মুখে একদম অন্য টানে বাংলা সংলাপ। কোথায় সফিস্টিকেটেড রূপা গঙ্গোপাধ্যায় আর কোথায় নয়নচাঁপা! আর দামিনী? রূপার বাড়িতে মেক আপ করার সময় কালচারাল অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে এমফিল করা অভিনেত্রী দামিনী গল্প করছিলেন জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ নিয়ে। কিন্তু যখন মালতীর চরিত্রে, তখন ভাল করে ‘ন’-ও বলতে পারেন না তিনি। তাই নয়নচাঁপা হয়ে যায় ‘লয়-দি’।

রুবি ক্রস করে ভিড় ঠেলে গাড়ি এগিয়ে চলল একটা কমপ্লেক্সের দিকে।

বিকেল ৪.০০

কমপ্লেক্স থেকে হেঁটে বেরোচ্ছিলেন এক মধ্যবয়সী মহিলা। তাঁর সঙ্গে এক দম্পতি। একই আবাসনে থাকেন সবাই। “ও দিদি, তোমাদের এখানে কাজের লোক লাগবে?” শুনেই মহিলা মাথা নাড়ালেন। “আরে, ওই যে সামনে বিশুর দোকানে বলল যে এক মহিলা আছেন এখানে। হাঁটতে পারেন না। ওদের বাড়িতে নাকি লোক লাগবে?” ভদ্রমহিলা সামান্য ভাবলেন। তার পর বললেন, “ফ্ল্যাটের নম্বরটা না বললে কী করে বলব বলো তো!”

রূপাকে চিনতে পারলেন না। আর দামিনী? একদম অপরিচিত মুখ। রূপা-দামিনী এগিয়ে গেলেন। মিনিট দুই পর যখন আনন্দ প্লাস-এর তরফ থেকে জানানো হল যে কাজ খুঁজতে আসলে এসেছিলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, তখন ভদ্রমহিলা অপ্রস্তুত। “আমার মনে হয়েছিল চেনা-চেনা লাগছে। মুখটা দেখে বুঝতে পারিনি। কিন্তু যেই পায়ের দিকে তাকালাম, মনে হল কেমন যেন বেমানান। মুখটা শ্যামবর্ণা। কিন্তু পা-টা কী ফর্সা! ম্যানিকিয়োর করা। আমিও দেখেই বুঝেছি আর যাই হোক, উনি কাজের লোক নন।”

বিকেল ৪.১৫

সোজা রাস্তা ধরে আরও খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে আর এক আবাসিকের সঙ্গে দেখা। মহিলা বেশ রেগেই গেলেন রূপাদের প্রশ্ন শুনে। “বুঝি না, কী করে লোকেরা এখানে এ ভাবে ঢুকে যায়। যত্তোসব!” বলে হনহন করে এগিয়ে গেলেন তিনি। রূপা তখন বেশ খুশি। মেন গেট দিয়ে এরই মধ্যে ঢুকেছেন আরও এক দম্পতি। রূপা-দামিনীর প্রশ্ন শুনে তাঁরাও বেশ বিব্রত। “আমাদের কোনও কাজের লোকের দরকার নেই...,” বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট তাঁদের মুখে। হাঁটা লাগিয়ে এগিয়ে যান দু’জনে। পিছন থেকে রূপা ছুটে এগিয়ে আসেন। “সরি, সরি, নমস্কার। আমি রূপা গঙ্গোপাধ্যায়! আমাদের একটা ছবি মুক্তি পাচ্ছে এই শুক্রবার। সেই ছবির চরিত্রের সাজে আমি এখানে। দেখছিলাম চেনা যাচ্ছে কি না...,” বলে একগাল হাসি। দম্পতি বেশ অপ্রস্তুত। “আসলে এখন সিকিউরিটিটা এত বড় ব্যাপার যে যে-সে কাজ চাইলে ও রকম কিছু বলা যায় না...,” বলেন তাঁরা। পাশ থেকে ভদ্রমহিলা বলেন, “মুখটা বেশ চেনা-চেনা লাগছিল। কিন্তু ভাবলাম এখানে রূপা গাঙ্গুলি কী করে আসবে!”

বিকেল ৪.৩০

আবাসন থেকে এ বার বেরিয়ে আসার পালা। ঠিক হল রাস্তায় গিয়ে রূপা-দামিনী ঝগড়া করার অভিনয় করবেন। ভুলুকে কেক খাওয়ানো নিয়ে ঝগড়া। কিন্তু তার আগে দামিনী সাবধান করে দিলেন রূপাকে। “দু’বার তুমি ক্যাবলার মতো হেসে ফেলেছ। তাই লোকেরা ধরে ফেলল। এ বার কিন্তু ঝগড়া করতে গেলে ফ্যাকফেকিয়ে হেসে দিয়ো না,” বলেন দামিনী। তার পর ভুলুকে কাঁখে নিয়ে হনহন করে এগিয়ে যান।

হাঁটার ধরন দেখে মনে হয় এই বুঝি ক্যানিং লোকাল থেকে নেমে সোজা এসেছেন কাজের খোঁজে। চোখমুখ কুঁচকে চিত্‌কার করে বলেন, “ও লয়-দি, ছোট ছেলেটা একটা কেক চাইছে আর তুই ওটাও দিতে পারছিস না?” রূপাও কম যান না। বললেন, “আরে, কেক চাইলেই কেক দিতে হবে নাকি? জানিস দাম কত? কাজ নেই, তার পর আবার কেক চাইছে। সাধ কত!” দামিনী আরও উচ্চস্বরে চিত্‌কার করে ঝগড়া করতে থাকেন। “কী কিপটে রে তুই। ছেলে একটু খেতে চাইছে আর তুই দিবি না! নে, আমি দশ টাকা দিচ্ছি। ও দাদা, একটা কেক হবে?” রাস্তার ধারে এক দোকানদার গম্ভীর ভাবে বললেন, “না, কেক নেই। মোয়া আছে। চলবে?” দূরে দাঁড়িয়েছিলেন পরিচালক। বললেন, “দেখে মনে হচ্ছে, দু’জন একদম চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে।”

বিকেল ৪.৪০

ভুলুর মোয়া পছন্দ নয়। রূপা-দামিনী এ বার এগিয়ে গেলেন একটা রোলের দোকানের সামনে। তখনও দোকানের মালিক আসেননি। সন্ধের আগে দোকান খুলবে না। তবে কর্মচারী আস্তে আস্তে দোকান পরিষ্কার করতে শুরু করেছেন। “ও দাদা, বিশুর দোকানে বলল, আপনার কাছে বললেই কাজ পাওয়া যায়!” কর্মচারীটি বললেন, “আজ কোনও খবর নেই। কাল এসো। থাকলে বলব।” দোকানের সামনে একটা ছোট্ট বেঞ্চ। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য বসলেন রূপা-দামিনী। বেশ অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। ফিসফিস করে রূপা বললেন, “দেখুন, এখানে বসে আছি আর ওই লোকটা পেছন থেকে রোলের টেবিল পরিষ্কার করার ছুতোতে পিঠে একটু হাত বোলানোর চেষ্টা করল!” তবে বেশি কিছু গণ্ডগোল হওয়ার আগেই আবার অন্য পালা শুরু।

বিকেল ৪.৫০

এ বার ভুলুকে ভ্যানে চাপানোর চেষ্টা। ভ্যানওয়ালা কিছুতেই অত কম দূরত্বে ভাড়া নেবেন না। রূপাও নাছোড়বান্দা। “এত ছোট ছেলে! শুধু রাস্তা পার করে দেবে, তাতে তোমার অত ঝামেলা কীসের গো? দশ টাকা দেব!” বললেন রূপা। ভ্যানওয়ালা কিছুক্ষণ তর্ক করলেন, তার পর মুখে একগাল হাসি। “আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। আপনি তো রূপা গাঙ্গুলি!” রূপার মুখে হাসি। বোঝা গেল আর বেশিক্ষণ রাস্তায় দাড়িয়ে নয়নচাঁপার কাজ খোঁজা যাবে না। ফিরে যাওয়ার আগে আর একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। আলুর চপের দোকানের সামনে এক মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন। মিটমিট করে হাসছিলেন। জিজ্ঞেস করা হল, চিনতে পেরেছেন ওঁরা কারা? “আমার চোখ ফাঁকি দেবে! এটা হতেই পারে না। ওই দু’জন হল হিজড়ে। বাচ্চা কোলে নিয়ে ভিক্ষা করার ধান্দা। মুখেই বলছে যে, কাজ খুঁজছে। আসলে ভিক্ষে চাইছে। আমি চঞ্চলা মণ্ডল। মনটা আমার সব সময় চঞ্চল থাকে। আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না!”

রূপা হেসে বললেন, “শেষে হিজড়ে?”

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

rupa ganguly rupa gangopadhay priyanka dasgupta noyonchanpar din ratri ananda plus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy