আমার মতো যে সব নিম্নমধ্যবিত্তর জন্ম ১৫ অগস্ট ১৯৪৭-এর ঠিক পরে, যাদের সম্পর্কে বলা হয় ‘এরা ভারতের স্বাধীনতার সমানবয়সী’, তাদের একটা সাধারণ অভিজ্ঞতা হল, বাবা-কাকা-দাদুদের, এমনকি ঠাকুরমা-দিদিমাদেরও, অনেকেই সগর্বে বলতেন, আমরা ব্রিটিশ জমানায় বড় হয়েছি, বুঝলি! তার কেতাই আলাদা। সে জমানায় এক বার কেউ বার্ড কোম্পানি কিংবা অ্যান্ড্রু ইয়ুলে কিংবা বামার লরিতে কেরানি হয়ে ঢুকলে বংশ পরম্পরায় কেরানির চাকরি করার সুযোগ পেত। মেয়েরা এমন উড়নচণ্ডী হবার সুযোগ পেত না। শিক্ষিত লোক মাত্রেই ইংরিজি জানত, তখন ‘ডিসিপ্লিন’ ছিল, বিশেষ করে ‘ছোটলোকদের’ বাড়বাড়ন্ত ছিল না। চাকরদের জুতোপেটা করলে তারা হাতেপায়ে ধরত। চাইলেই ঝি-চাকর পাওয়া যেত। আর পাওয়া যেত অসম্ভব সুস্বাদু বিস্কুট আর মাখন।
মেট্রোয় কিংবা নিউ এম্পায়ারে সিনেমা দেখতে যাওয়া আমাদের ছোটবেলায়, পঞ্চাশের দশকে, একটা রীতিমতো উৎসব ছিল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফুটপাত, ঠান্ডা মেশিনের হাওয়া, পুরু কার্পেটে ডুবে-যাওয়া গোড়ালি আমাদের বিমোহিত করত। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে শুনতাম, এ আর কী দেখছিস, ব্রিটিশ আমলে এ সব জায়গা যা ছিল! কেউ কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাসও ফেলতেন। একই কথা ইডেন গার্ডেন নিয়ে। সেখানকার ব্যান্ড-এর কথা বলতে গিয়ে কারও কারও চোখে জল এসে যেত। তখন কলকাতার রাস্তাঘাট নিয়ম করে ধোয়া হত, আর, অবাক কথা, কলেজ স্ট্রিট, মির্জাপুর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো, সে নাকি ছিল স্বর্গসুখ।
এমনও শুনতাম, পঞ্চাশটা কালো চামড়া তারস্বরে গুলতানি করছে, এমন সময় একটা লালমুখো এল, সবাই সন্ত্রস্ত। গল্প শুনতাম, যুদ্ধের সময় এক তরুণ সন্ধেবেলা এসপ্লানেডের ফুটপাত দিয়ে ছাতা দোলাতে দোলাতে আপন মনে দুলকি চালে চলছিলেন, এমন সময় পিছন থেকে ছাতার ওপর দুর্জয় এক লাথি। ছাতাটা আকাশে প্যারাবোলা এঁকে রাস্তার ওপারে গিয়ে পড়ল। গোরা সৈন্যর লাথি! ছাতা দোলানো তার পছন্দ হয়নি। প্রতিবাদ? সাহেবের বিরুদ্ধে? মাথা খারাপ নাকি? কার এত হিম্মত? অথচ ওই তরুণ কিন্তু বিষ্টু ঘোষের আখড়ায় কুস্তি শিখতেন। একটু যেন তারিফেরই সুর খুঁজে পেতাম এ সব স্মৃতিচারণে। রাজার জাত কি এমনি-এমনি?