Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪
Independence Day 2019

স্বাধীনতা দিবস হল অন্যের ‘না’-কে সম্মান করার দিন

স্বাধীন দেশে কি তবে মুষ্টিমেয় কয়েক জনই সবার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? প্রশ্ন তুললেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তীস্বাধীন দেশে কি তবে মুষ্টিমেয় কয়েক জনই সবার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? প্রশ্ন তুললেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

‘না’ বলতে দেওয়ার মতো পরিসর তৈরি করাই তো আসলে স্বাধীনতা! অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

‘না’ বলতে দেওয়ার মতো পরিসর তৈরি করাই তো আসলে স্বাধীনতা! অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৯ ২০:৩৭
Share: Save:

আমাদের ছোটবেলায় স্বাধীনতা দিবস ছিল এক মজার দিন! হ্যাঁ মজার দিন, গুরুত্বপূর্ণ দিন নয়। কারণ সেই নয়-দশ বছর বয়সে এই দিনটার গুরুত্ব বোঝার মতো মানসিক পরিণতি তখনও হয়নি আমাদের।

সেই সময়ে আমরা এই ভেবেই খুশি হতাম যে ছুটির খরা চলে এমন দুটো মাস, মানে জুলাই আর অগস্টে, একটা তো দিন পাওয়া গেল যে দিন স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে না! বরং সে দিন সকালে উঠে আমাদের সেই ছবির মতো সুন্দর মফস্সলের রাস্তায় আমরা দেখতে পাব কুচকাওয়াজ! দেখতে পাব নানা রকমের ট্যাবলো। আর পাব মুখোশ, লজেন্স, মিষ্টির প্যাকেট!

তার পর পাড়ায় ফিরে বসে পড়তে পারব যেমন খুশি আঁকো প্রতিযোগিতায়! বিকেলে হবে ফুটবল টুর্নামেন্ট আর সন্ধেবেলা পাড়ার ক্লাবে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে খিচুরি!

ছোটবেলায় স্বাধীনতা দিবস ছিল এক অদ্ভুত পাখা মেলে ওড়ার দিন!

হ্যাঁ, স্বজ্ঞানে না হলেও স্বাধীনতা কী সেটা সামান্য হলেও সেই সময়তেই কিন্তু প্রথম কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম আমি। কারণ, ধরা-বাঁধা সিলেবাসের শৃঙ্খলের বাইরে থাকতে পেতাম সেই দিনটায়। ‘এই অঙ্কটা করতেই হবে’, ‘ওই ব্যাকরণটা জানতেই হবে’-র বাইরে নিজের ইচ্ছেমতো থাকার দিন ছিল ছোটবেলার আমার স্বাধীনতা দিবস!

এখন সেই সব দিন থেকে অনেক বছর সরে এসে যেন আরও বেশি করে বুঝতে পারি এই দিনটার কী গুরুত্ব! নিয়মও যে এক ধরনের শৃঙ্খল, সেটাও যে ক্রমাগত আমাদের মনের ওপর চেপে বসতে বসতে আমাদের দীর্ণ করে সেটা এখন খুব বেশি করে বুঝতে পারি! আরও এ সব বুঝতে পারি গত কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের চারপাশটা অদ্ভুত ভাবে বদলে যাওয়ায়!

স্বাধীনতা আসলে একটা মানসিকতা। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

যাঁদের হাত ধরে পাওয়া এই স্বাধীনতা, তাঁদের সম্পর্কে এগুলো জানেন?

স্বাধীনতা কোনও মাটির পুতুল, কাঠের চেয়ার বা দলের পতাকা নয়। একে হাত দিয়ে ধরা যায় না। ঘরে এনে সাজিয়ে রাখা যায় না। একে কাঁধে করে তুলে মিছিল করা যায় না। স্বাধীনতা আসলে একটা মানসিকতা। জীবনযাপনের একটা বহিঃপ্রকাশ। কারও কাছে সেটা রাজনৈতিক হতে পারে, কারও কাছে সামাজিক আবার কারও কাছে সেটা হতেই পারে একান্ত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে মানুষের মননের কাছে এর অর্থ হল মুক্ত হয়ে জীবনযাপন করা। যেটা তার পছন্দ নয় সেটাকে সপাটে ‘না’ বলে নিজের মতো এগিয়ে যাওয়া!

এখন নিজের মতো বাঁচা, নিজের ইচ্ছেয় বাঁচা— এই কথা বা মনোভাবের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ‘হেডনিজম’ থেকেই যায়! মনে হতেই পারে, তবে কি অন্যের সুখ-দুঃখগুলো আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না? আমরা কি নিজেদের নিয়ে এতটাই বিভোর হয়ে থাকব যে অন্যের সুবিধে অসুবিধে কিছু দেখব না?

এখন এমনটা সবাই যদি ভাবতে থাকে তা হলে একটা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। সৃষ্টি হবে অকল্পনীয় এক নৈরাজ্যের! সেটা যাতে না হয় তাই রাষ্ট্র নিয়ে এসেছে নানান বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন। কারণ, ইতিহাস জানিয়েছে মানুষের নিজের শুভবুদ্ধির ওপর সবটা ছাড়লে খুব একটা ভাল ফল পাওয়া যায় না। কারণ প্রাণী হিসেবে মানুষের জন্মগত স্বার্থপরতা অন্যের স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাই বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রকেই হাতে তুলে নিতে হয়েছে তার দেশের মানুষকে স্বাধীন রাখার দায়িত্ব!

অর্থাৎ এটা বোঝা যাচ্ছে যে প্রকৃত অর্থে কিন্তু কেউই স্বাধীন নয়। সবাইকেই কিছু না কিছু নিয়ম মেনে চলতেই হয়। কিন্তু যেহেতু সেটা আমাদের জীবনযাপনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে কোনও রকম ছন্দপতন ঘটায় না, আর আমরা এটাও বুঝি যে এইসব নিয়মকানুন থাকার জন্য একটা শান্তিশৃঙ্খলার পরিবেশ বজায় থাকে, তাই এই ‘কন্ট্রোল্‌ড’ স্বাধীনতা আমরা মেনে নিয়েছি। আর রাষ্ট্রও মেনে নিয়েছে অন্যকে ক্ষতি না করে নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার ও ‘না’ বলার অধিকার।

প্রকৃত অর্থে কিন্তু কেউই স্বাধীন নয়। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

ছবি দেখে চিনতে পারবেন স্বাধীনতার এই কারিগরদের?

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে সেটা কতটা পালিত হচ্ছে? চারিদিকে যেমন অবস্থা সেখানে আমরা আসলে কি সত্যি স্বাধীন! এখানে কি ক্রমশ একটা ‘জোর যার মুলুক তার’ ধরনের অবস্থা তৈরি হচ্ছে না? কয়েক বছর আগেও জনগণ জানতই না ‘ইন্টলারেন্ট’ শব্দটার অর্থ কী! কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। হেট ক্রাইম, গণপিটুনির মতো নানান ঘটনার ফলে মানুষ যেন কিছুটা ভীত ও কোণঠাসা! নানান ভয়ের শব্দ এসে ভিড় করছে আমাদের চারিধারে। সত্যি কথা স্বাধীন ভাবে বলার আগে মানুষ ভাবছে আদৌ এ সব বলা বলা ঠিক হবে কি না! বললে না জানি কী বিপদ ঘনিয়ে আসবে!

বর্তমানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসর অদ্ভুত ভাবে পালটে যাচ্ছে! যে অঞ্চলে যাদের ভোটের জোর বেশি, সেই অঞ্চলে তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! তারাই ঠিক করে দিচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ কী হবে! তাদের মতের সঙ্গে না মিললেই তারা বের করে ফেলছে দাঁত নখ। মানুষকে ভয় দেখিয়ে তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়াটা যেন ক্রমশ একটা প্রচলিত ধারা হয়ে উঠছে! বাক স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ক্ষমতাশালীরা বলছে, এই তো তোমাদের প্রশ্ন করার জায়গা দিচ্ছি! ভাবটা এমন, যেন নিজেদের ঘরের থেকে দিচ্ছে! জন্মগত ভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে যা পাওয়ার কথা সেটা পেতে গেলেও এমন অবস্থায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে তাতে মনে হচ্ছে যেন তাদের ওপর দয়া করা হচ্ছে!

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে যে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা প্রাণ দিয়েছিলেন দেশকে পরাধীনতার করাল গ্রাস থেকে বের করার জন্য, তাঁরা হয়তো কল্পনাও করেননি, এমন একটা জায়গায় এসে পড়বে তাঁদের প্রিয় জন্মভূমি!

ক্ষমতাশালীদের পার্টিলাইনের পরিপন্থী হলেই কাউকে দেগে দেওয়া যাবে নানান অভিধায়! সবার সামনে স্রেফ গলা আর ক্ষমতার জোরে বিরুদ্ধমতকে বলে দেওয়া যাবে শত্রু! এ কোন স্বাধীনতার রূপ দেখছি আমরা! ক্ষমতা-লিপ্সাই কি তবে শেষ কথা হয়ে থাকবে? স্বাধীন দেশে কি তবে মুষ্টিমেয় কয়েক জনই সবার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে? নিজের ইচ্ছে মতো বাঁচার, মতামত দেবার, খাদ্য সেবন করার বা ভালবাসার প্রকৃত অধিকার কি তবে নেই! ক্ষমতাশালীদের বক্তব্য ভাল না লাগলে কি কারও তবে সেটার প্রতিবাদ করার, সেই বিষয়ে ‘না’ বলার অধিকার থাকবে না? জীবনের সব ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে কি মুষ্টিমেয় কিছু রাজনৈতিক দল সর্বগ্রাসী ক্ষমতার কথাই ভাববে শুধু! প্রকৃত স্বাধীনতা কি সত্যি কোনও দিন পাবে না জনগণ?

বিজ্ঞানে দেশ এগোচ্ছে! টেকনোলজি ট্রানজাকশনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে ভারতের স্থান ওপরের দিকে। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রেও ভারতের স্থান পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে। এমতাবস্থায় সরকারও চাইছে মানুষ আরও বিজ্ঞানমনস্ক হোক। সেখানে ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’-এর মতো যদি আমরা দেখি এই দেশেই অন্য দিকে মানুষের নিজের মতো থাকার অধিকার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খর্ব করা হচ্ছে, তা হলে দেশের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা হবেই। কারণ আমরা এক সময় চলে গেলেও আমাদের সন্তানসন্ততিরা এই দেশেই থেকে যাবে। তাদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত ও স্বাধীন করার কথাও আমাদেরই ভেবে যেতে হবে।

স্বাধীনতা ইট-কাঠ-পাথর নয়, স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা বাঁচার ভঙ্গিমা! সেটার সার্বিক পুনরুজ্জীবন একান্ত দরকার। যে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছে সে-ও যে দেশের ভাল চায়, নানান কাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরে দিয়ে তা শোধরাতে চায়, সেটা বোঝার মতো মনের প্রসারতা থাকা দরকার! অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়া, তাকে ‘না’ বলতে দেওয়ার মতো পরিসর তৈরি করাই তো আসলে স্বাধীনতা! সেটা না হলে, যতই রকেট চাঁদে যাক আমরা কিন্তু সেই মধ্য যুগের অন্ধকারের দিকেই পিছিয়ে যাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE