Advertisement
E-Paper

ভাষা আর দেশের জন্য অনন্ত আবেগ

বাংলাদেশের গৌরব তাঁর নিজের গৌরব। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতাকেই নিজের আজীবন অর্জন করে তুলেছেন আনিসুজ্জামান।বাংলাদেশের গৌরব তাঁর নিজের গৌরব। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতাকেই নিজের আজীবন অর্জন করে তুলেছেন আনিসুজ্জামান।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৪৮
ছবি: সুব্রত চৌধুরী

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

বয়স মাত্র পনেরো। হঠাৎই বিরাট এক দায়িত্ব এসে পড়ল ঘাড়ের ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তখন পূর্ব পাকিস্তানি মানুষের আন্দোলন চলছে, তাতে একটা প্রচ্ছন্ন কিন্তু গুরুতর ভূমিকা নিতে হল তাঁকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির এক বিরাট অংশ, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিক্ষুব্ধ ভূমিকা নিয়েছে ও-বাংলার ছাত্রসমাজ। আন্দোলনে সংগঠনে সব কিছুতে তারাই সামনে এগিয়ে। এরই মধ্যে উনিশশো বাহান্ন সালের জানুয়ারি মাসে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদ তৈরি করলেই তো হল না, ভাষার দাবি বলতে ঠিক কী বোঝায়, কেন সেই দাবি পাক শাসকদের সামনে সমস্ত শক্তি দিয়ে তুলে ধরা দরকার, কেন এ কথা বলা দরকার যে বাংলা ছাড়া বাঙালি মুসলমানের অস্তিত্ব সম্ভব নয়, এগুলো তো মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে। সুতরাং ঠিক হল, পরিষদের পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে একটি পুস্তিকা বার করা হবে। কিন্তু লিখবে কে?

ঠিকঠাক লেখার লোক পাওয়া যাচ্ছে না দেখে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নেতারা ঠিক করলেন একটি প্রচারপত্র লেখা হোক। আর সেই কাজটাই কী ভাবে যেন এসে পড়ল পনেরো বছরের ছেলেটির উপর। সে তখন সবে ম্যাট্রিক পাশ করে জগন্নাথ কলেজে আইএ প্রথম বর্ষের ছাত্র, তাকেই লিখতে হল ভাষা আন্দোলনের অর্থ। পুস্তিকার নাম হল ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’

এই লেখাই কিশোর আনিসুজ্জামানের প্রথম সওয়াল, বাংলা ভাষার পক্ষে! এই লেখাই পূর্ব পাকিস্তান কিংবা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রথম সওয়াল বাংলা ভাষার অধিকারের পক্ষে! সে দিন থেকে শুরু। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুলুক-সন্ধানে মানুষটি ব্যস্ত থাকবেন আজীবন, নতুন নতুন ভাবনা আর তথ্য তাঁর কাছ থেকে পেতেই থাকবে দুই বাংলা।

আশ্চর্য সমাপতন বলতে হবে। আজ আশির দুয়ার ছুঁয়ে আনিসুজ্জামান পিছন দিকে তাকিয়ে বলতেই পারেন ইতিহাসবিদ হবসবমের সেই কথা — এক অসাধারণ টালমাটাল শতাব্দীতে তাঁর বসবাস, তাঁর যাত্রা, তাঁর গন্তব্য সন্ধান। ভাষার দাবি দিয়ে যে দেশের শুরু, সেই দেশের গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরও গোড়াপত্তন। ভাষা আর দেশের জন্য কতখানি আবেগ থাকলে দুরন্ত কৈশোরে অমন একটা বিষয়ে লেখা যায় বুঝতে কষ্ট হয় না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতখানি আবেগ থাকলে প্রথম থেকে বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ছায়া নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তাঁর বাংলা নিয়ে পড়াশোনা শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই প্রথম বর্ষ অনার্সের ছাত্র প্রবন্ধ লিখে ফেলেন, ‘আনন্দমঠ ও বঙ্কিম-প্রসঙ্গ’। সাহিত্য অধিবেশনে সেটা পড়াও হয়। প্রবন্ধটি এত জোরালো যে শোনামাত্র অধ্যাপক মহম্মদ মনসুরউদ্দিন উত্তেজিত হয়ে সভাতেই হইচই শুরু করেন যে ছেলেটিকে এখনই পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হোক! — কোথা থেকে এল বাংলার প্রতি এমন আবেগ, পড়ুয়াটির মনে?

কলকাতায় জন্ম ছেলেটির, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭। বাবা ছিলেন ডাক্তার, মা গৃহিণী, লেখালেখিতেও উৎসাহ। শৈশবের দিনগুলি কেমন কাটত শহর কলকাতায়, নানা সাক্ষাৎকার নানা লেখায় অনেক বার বলেছেন আনিসুজ্জামান।

কেবল গল্প নয়, সাক্ষাৎ ইতিহাসের উপাদান সে সব কাহিনি। ছেচল্লিশের দাঙ্গা তিনি দেখেছিলেন চোখের সামনে।

বাবা প্রথমে মানতে চাননি কলকাতা থেকে বাস ওঠানোর প্রস্তাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভবিতব্য মানতেই হল। বাবা-মা চলে এলেন পুব বাংলায়, কিন্তু কাকারা থেকে গেলেন পশ্চিমবাংলায়, গ্রাম ছাড়ার কথা তাঁরা কানেও তুললেন না। বাবার সঙ্গে প্রথমে এলেন খুলনায়, কলকাতার কাছাকাছি, যদি পরিস্থিতি পালটায় সেই আশায়। তার পর আস্তে আস্তে ঢাকা। কলকাতার পার্ক সার্কাস স্কুলে সপ্তম শ্রেণি, খুলনা জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণি, তার পর ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। তিনি সেই স্কুলের শেষ ব্যাচ। তার পরই স্কুলটি সরকারি হয়ে যায়, নাম পালটা হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। নতুন দেশের গোড়াপত্তন তাঁর ব্যক্তিগত ইতিহাসের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।

নতুন দেশের দ্বন্দ্বের সঙ্গেও নিশ্চয় কোথাও বাঁধা ছিল তাঁর মনটি। এই সেই দেশ, যার সামনে এক নাছোড় প্রশ্ন ঘুরপাক খায়— শরৎচন্দ্রের ভাষায় সে প্রশ্ন: ‘বাঙালি না মুসলমান?’ এ যে কোনও প্রশ্নই হতে পারে না, বাঙালি মুসলমান যে সত্যিই বাঙালির অর্ধেক আকাশ, তা নিয়ে কিন্তু অনেক কথা, অনেক ভাবনা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। মহম্মদ আকরম খান রেগেমেগে বলেছিলেন, ‘দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী, উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্ন তাহার মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে, না বেল?’ আশ্চর্য নয় যে, আনিসুজ্জামানের মনের গভীরতম সন্ধানটিও উঠে এল এই প্রশ্নাতীত পরিচিতির অধিকারসূত্র ধরে। বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান চিন্তাধারার জায়গাটা কী ও কেমন, তাই নিয়ে তিনি গবেষণার দুনিয়ায় পা রাখলেন।

এবং তাঁর গবেষণা ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ হয়ে রইল আক্ষরিক অর্থে কালজয়ী। তাঁর লেখাতেই প্রবল প্রত্যয়ে এ কথা ঘোষিত হল যে মুসলিম-রচিত বাংলা সাহিত্যের কোনও ইতিহাস আলোচনার সবচেয়ে বড় অসুবিধেটা হল, এই বিষয়ে সামাজিক ইতিহাসের অভাব। আঠারো শতক থেকে বাঙালি মুসলিম সাহিত্যের অনুসন্ধান শুরু করা ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না। তিনি বুঝেছিলেন, ওই সময়ের গভীরপ্রসারী সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে মিলিয়ে না দেখলে মুসলিম বাংলার সাহিত্য-ঐতিহ্যের ঠিকঠাক মূল্যায়ন করা যাবে না। আর বাঙালির সাহিত্য-ইতিহাসও থাকবে অসম্পূর্ণ। আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলা ভাষায় লেখা অনেক চিঠিপত্র তিনি সংকলন করে সম্পাদিত করেছিলেন। এই চিঠিগুলো বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এক নতুন আলো ফেলেছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও কেরির আমলেরও আগে বাংলা গদ্য কেমন ছিল, তার একটা স্পষ্ট ধারণাও মিলেছিল সেই সব চিঠি থেকে। এই বিষয়ে এর পর কতই তো গবেষণা হয়েছে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের মুসলিম আইডেন্টিটি নিয়ে আজও পড়াশোনা শুরু করতে হলে, ১৯৬২’র ওই সন্দর্ভটি অপরিহার্য!

পণ্ডিত মানুষটির কাজকর্মের পরিসর নানা দিকে বিস্তৃত। আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক সেই পরিসর। কিন্তু সে সবই যেন তাঁর খণ্ড পরিচয়। আনিসুজ্জামান মানুষটিকে কিছুতেই বোঝাই যাবে না, বা তাঁর কাজকর্মের মধ্যে নিহিত প্রবল আবেগটাকেও বোঝা যাবে না যদি না মনে রাখি কী ভাবে বার বার, দেশের প্রতিটি সংকট-মুহূর্তে পাণ্ডিত্যের দুনিয়াটা ছেড়ে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজকর্মের মধ্যে ঢুকে এসেছেন তিনি। সম্ভবত তাঁর মনে হয়েছে, বাঙালি মুসলিম পরিচিতির গবেষণা করে কী-ই বা হবে, যদি না বাস্তব জীবনে সেই পরিচিতিটাকে প্রাণমন দিয়ে আগলাতে পারেন? আইডেন্টিটি-দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাকে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের জীবনে তো কম দুর্যোগ আসেনি! কম বার তো দেখা যায়নি সৌম্যদর্শন মানুষটি অটল বিশ্বাসে আর সততায় তুলে ধরছেন বাঙালি ও মুসলিম এই যৌথ পরিচয়ের গরিমা! ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথের গান যখন পাকিস্তানের ভাবাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছিল পাক সরকার, প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে সংগ্রামে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ভারতে এসে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। আশির দশকে এরশাদের বাংলাদেশ যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করল, মুখর হয়েছিলেন প্রতিবাদে। এখনও যে কোনও গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দাবির পক্ষে তাঁর স্বর শোনা যাবেই। রাজনৈতিক আন্দোলনের দায় বলতে তিনি কী বোঝেন, তাঁর নিজের কথা থেকেই তা পরিষ্কার ভাবে ধরা যায়: ‘আমাদের দেশে যতগুলো আন্দোলন সফল হয়েছে, সেই ’৫২ সালে, সেই ’৬৯ সালে, সব আন্দোলনগুলিতেই বুদ্ধিজীবীরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তাঁরা সাধারণ মানুষের কথাই বলেছিলেন।’ মুক্তিযুদ্ধকেও তিনি বুঝেছিলেন নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতির জন্য সাধারণ মানুষের আকুতি হিসেবে।

‘মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরুদ্ধে গেলে দেশ থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে না’, এক বার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি। এই আদর্শের অর্থকে আরও প্রসারিত করা দরকার, মনে করেন তিনি। এক মুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলার প্রতি দিনের জীবন, প্রতি দিনের পালন করে তোলা দরকার সেই আদর্শকে, তাঁর বিশ্বাস। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নিজের সংসারও সেই বিশ্বাসে মাখামাখি। পয়লা বৈশাখ, নববর্ষের দিন— এ কথা না মনে করে উপায় নেই যে সদাপ্রসন্ন নিরভিমান মানুষটির ঢাকার অবারিত-দ্বার বাড়িতে প্রতি বছর এই দিনটিতে কী এক আশ্চর্য মায়াময় ছবি তৈরি হয়ে উঠতে দেখা যেত! কত মানুষের অবাধ যাওয়া-আসা চলত সে দিন ওই বাড়িতে, হাসিখুশিমাখা কত চেনাচিনি, খাওয়াদাওয়া, গান, আড্ডা। পয়লা বৈশাখ তাঁর বাড়িতে যেন সত্যিই এক মুক্ত মিলনমেলা।

বাংলা নববর্ষ তাঁর কাছে নিজের বাড়ির উৎসব। বাংলাদেশের গৌরব তাঁর নিজের গৌরব। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর নিজের আজীবন অর্জন।

বাংলার সেই গৌরব কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলুন তিনি, আরও অনেক নববর্ষ পেরিয়ে!

Poila Baisakh Special Poila Baisakh Celebration Bengali New Year Celebration Celebrities Anisuzzaman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy