Advertisement
E-Paper

এইচআইভি নিয়ে নয়া বিল শিকেয়, হারুনরা অন্ধকারেই

এখনও ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে উঠতে পারেননি হারুন শেখ। অন্যের ক্ষেতে চাষ করে দিন গুজরান করা এই প্রৌঢের একমাত্র ছেলে এইচআইভি পজিটিভ। লিখছেন সোমা মুখোপাধ্যায়

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:১৪

এখনও ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে উঠতে পারেননি হারুন শেখ। অন্যের ক্ষেতে চাষ করে দিন গুজরান করা এই প্রৌঢের একমাত্র ছেলে এইচআইভি পজিটিভ। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মুম্বইয়ে কাজ করতে গিয়েছিলেন হারুনের ছেলে হাবিব। দু’বছর পরে বাড়ি ফেরেন ধুঁকতে ধুঁকতে। প্রথমে গ্রামীণ হাসপাতাল, তার পর জেলা হাসপাতাল, তার পর বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ। একের পর এক জায়গায় ঘুরেছেন। সরকারি তরফে চিকিৎসা জুটেছে ঠিকই। কিন্তু কখনও পুরোটা, কখনও আধা। কখনও সব ওষুধ পেয়ে যান, সব পরীক্ষা নিখরচায় হয়ে যায়। আবার কখনও শুনতে হয়, ‘ওষুধের সাপ্লাই নেই’। শুনতে হয় ‘পরীক্ষার মেশিন খারাপ’। বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনে দেওয়ার ক্ষমতা নেই হারুনের। ক্ষমতা নেই শহরের ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পরীক্ষা করানোরও। তাই তখন কার্যত বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকে তাঁর ছেলে। হারুন কখনও ছোটেন জেলায় এনজিও-র অফিসে। কখনও বা কলকাতায় স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এ। কখনও সেই ছোটাছুটিতে কাজ হয়, কখনও সবটাই থেকে যায় নিষ্ফলা।

এনজিও-র কর্মীরা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, আর মাত্র কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। জানিয়েছিলেন, এইচআইভি নিয়ে নতুন বিল আসছে। সেই বিল পাশ হলেই সব চিকিৎসা সরকার দিতে বাধ্য। বিল পাশ হলেই সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে একটু একটু করে মিটবে বৈষম্য। সেই আশায় বুক বেঁধেছেন হারুন।

কিন্তু তাঁর আশা পূরণ হবে কি? আপাতত দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে হারুনদের মতো মানুষদের সমস্যা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে কি সরকারের? এই প্রশ্ন এখন বহু মানবাধিকার কর্মীরই। এমনকী, প্রশ্ন উঠেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অন্দরেও।

এইচআইভি পজিটিভদের নিয়ে কাজ করা বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইতিমধ্যেই চিঠি পাঠিয়েছে দিল্লিতে। সরকার ও বিরোধী পক্ষের নেতাদের কাছে তাদের আর্জি, যাঁদের সঙ্গে কালোবাজারির ন্যূনতম যোগ থাকারও কথা নয়, দয়া করে তাঁদের জীবনটা শেষ হয়ে যেতে দেবেন না। নোট বাতিলের জেরে বিধ্বস্ত দেশে টাকার জন্য ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়া ছাড়াও আরও সমস্যা আছে। সেই সমস্যাকে দয়া করে সংসদে প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ দেবেন।


অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব? চলতি বছরের জুলাইয়ে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের একটি দল এ নিয়ে বৈঠকে বসেন। সংসদের স্থায়ী কমিটি বিল নিয়ে নানা সুপারিশও করে। কিন্তু সেই তৎপরতা এখন তলানিতে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক সূত্রে খবর, আপাতত এ নিয়ে ভাবার ফুরসতই নেই কারও। ফলে সংশোধনী বিলটির ভবিষ্যৎ কী তা জানা নেই কারওরই।

অথচ, এই বিলটিই হয়ে উঠতে পারত অসংখ্য মানুষের অধিকার অর্জনের হাতিয়ার। কারণ, এইচআইভি অ্যান্ড এডস প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল বিল, ২০১৪-র যে সংশোধনীটি গৃহীত হওয়ার কথা, সেই অনুযায়ী অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল চিকিৎসা পাওয়াটা এক জন এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তির আইনি অধিকার। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে এটা বাধ্যতামূলক। অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি এবং এইচআইভি-র বিভিন্ন অপারচুনিস্টিক ইনফেকশন-এর (যেহেতু এইচআইভি সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, তাই তার হাত ধরে আসে অন্য নানা সংক্রমণ) চিকিৎসা করতে সরকারই ব্যবস্থা করবে। সংসদের স্থায়ী কমিটি এই বিলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় রাখতে চেয়েছে। যেমন, এই বিলে স্পষ্টই বলা হয়েছে, এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে কোনও রকম বৈষম্য চলবে না। যদি কোথাও তা হয় তা হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অর্থাৎ দয়া নয়, প্রাপ্য। যদিও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বক্তব্য, আইন যেমন আসছে, তেমনই তার ফাঁকও আসছে। সেটা কী রকম? একটি সংগঠনের তরফে ক্ষিতীশ মণ্ডল বলেন, ‘‘বিল-এ বলা হয়েছে, চিকিৎসা পাওয়া রোগীর আইনি অধিকার। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার ‘যত দূর সম্ভব’ সেই রোগীদের চিকিৎসা দেবে। আমাদের ওই ‘যত দূর সম্ভব’ কথাটাতেই আপত্তি। ওই কথাটা প্রত্যাহার না করলে যে কোনও সরকার ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, সরকার চিকিৎসা না দিলে রোগীর তরফে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার রাস্তাটাও খানিকটা সঙ্কুচিত থাকবে।’’

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কর্তারা অবশ্য বলছেন, ফাঁক না রেখে সরকারের উপায় নেই। কেন? দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘আগে নিয়ম ছিল সিডি ফোর কাউন্ট যদি ৩৫০ হয়, তা হলেই সেই ব্যক্তি অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু নতুন নিয়মে রক্তে সিডি ফোর কাউন্ট ৫০০ হলেই তাঁকে ওই ওষুধ দিতে হবে। অর্থাৎ, এই নিয়ম চালু হলে আরও লাখখানেক রোগী চিকিৎসার আওতায় আসবেন। এই আর্থিক বোঝাটা নামানোর জন্য সরকার তো চেষ্টা করবেই। তাই এই ফাঁকফোঁকরের ব্যবস্থা।’’

কিন্তু এই আপত্তির দিকটুকু বাদ থাকলেও বিলটি এইচআইভি পজিটিভদের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়। এখনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি বিমার সুযোগসুবিধা পান না। যদিও বা কোনও সংস্থা সেই সুযোগ দেয়, সে ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের পরিমাণ দাঁড়ায় পাহাড়প্রমাণ। এই দিকটিতেও বড় ধাক্কা দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। ভাবা হয়েছে এক জন ওমবাডসম্যান নিয়োগের কথাও। পাশাপাশি বলা হয়েছে, এইচআইভি পজিটিভ-দের স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়াম সামান্য বেশি হতে পারে। কিন্তু মারাত্মক বেশি কখনওই নয়। প্রয়োজনে সরকার বিষয়টি ইনসিওরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (আইআরডিএ)-র কাছে নিয়ে গিয়ে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে।

রয়েছে অনেক ইতিবাচক দিকই। তবে এই সব কিছুই অপেক্ষা করছে সংশোধনীটি সংসদে গৃহীত হওয়ার উপরে। এই মুহূর্তে এ দেশে প্রায় ৩০ লক্ষ এইচআইভি পজিটিভ রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মহিলা। নতুন করে সংক্রমণের হার আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন-এর (ন্যাকো) এক কর্তার মতে, সংক্রমণ ছড়ানোর হার কমানো গিয়েছে, কারণ সচেতনতা বাড়ানোর জন্য লাগাতর প্রচার চলেছে। তিনি বলেন, ‘‘সংক্রমণের হার কমলেই যদি আত্মসন্তুষ্টি এসে যায়, তা হলে পরিস্থিতি যে কোন দিন উল্টো দিকে ঘুরতে বাধ্য। তাই প্রচার চালিয়ে যেতেই হবে। অন্য যত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাই আসুক না কেন, এই সমস্যাকে ভুলে থাকা যাবে না। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, এ দেশে বহু এইচআইভি পজিটিভ এখনও চিকিৎসার আওতার বাইরে। তাই চিকিৎসাকে সব স্তরে ছড়িয়ে দিতে সংশোধনীটি পাশ হওয়া জরুরি।’’

কিন্তু সেই জরুরি কাজটি কবে হবে? কবে স্বস্তির শ্বাস ফেলবেন হারুন শেখেরা?

Soma Mukhopadhyay WORLD AIDS DAY
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy