সকালবেলা ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়েছেন সুচরিতা। আগের দিন বিকেলে হঠাৎ পিঠে টান লেগেছিল, আজ ঘুম ভাঙার পরে যেন সোজা হয়ে বসতেই পারছেন না। অথচ দ্রুত তৈরি হয়ে পৌঁছতে হবে অফিসে, জরুরি মিটিং রয়েছে। এই অবস্থায় আর সময় নষ্ট করা যাবে না। ওষুধের ড্রয়ার খুলে তিনি হাতে তুলে নিলেন একটা চেনা ওষুধ। ব্যথা কমানোর জন্যই একবার লিখে দিয়েছিলেন চিকিৎসক। এ বার আর ডাক্তার দেখানোর সময় নেই, একটা খেয়ে নিলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল ব্যথা। ওষুধে ভরসা বাড়ল সুচরিতার। দু’-এক সপ্তাহ পরেই ফিরে এল ব্যথা। ওষুধ খেয়ে আবার দৌড়নো। মাসছয়েকের মধ্যে সেই ওষুধই রোজের সঙ্গী হয়ে উঠল। একদিন হঠাৎ অফিসে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন সুচরিতা। চিকিৎসকের কাছে গেলে জানা গেল, পেটের ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, কিডনির উপরেও প্রভাব পড়েছে ওই ব্যথা কমানোর ওষুধের। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই ঘটনা ব্যতিক্রম নয়, বরং খুবই সাধারণ।
ব্যথা কমাতে বাড়ছে বিপদ
চিকিৎসক সুবীর মণ্ডল জানাচ্ছেন, ব্যথা আসলে রোগের উপসর্গ। আঘাত লাগা, প্রদাহ বা সংক্রমণ— বিভিন্ন কারণে ব্যথা হতে পারে দেহের নানা অংশে। এটি প্রকৃতিপ্রদত্ত একটি সতর্কবার্তা। ব্যথা হলে তবেই বোঝা যায়, দেহে কোনও সমস্যা রয়েছে। সেটি চিহ্নিত করে শুরু হয় চিকিৎসা। বহু ক্ষেত্রে, যেমন ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি থাকলে অনেকের ব্যথার অনুভূতি চলে যায় বা কমে যায়। সে সব ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগ বেড়ে গিয়েছে নীরবে, কিন্তু চিকিৎসা শুরু হয়নি। তাই ব্যথা খারাপ নয়। তবে তা বলে কষ্ট সহ্য করে যেতে হবে, তেমনটাও নয়। সেখানেই আসে ব্যথা কমানোর ওষুধের উপযোগিতা।
কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই পেনকিলার বা বিভিন্ন রকম ব্যথা কমানোর ওষুধ খাওয়া বর্তমানে কার্যত নীরব মহামারির রূপ নিয়েছে। এ দেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) পেনকিলার সহজলভ্য, ফলে অনেকেই এগুলি খেয়ে নেন। তাঁরা ভাবেন, সামান্য ব্যথায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কী দরকার! কিন্তু পেনকিলারের যথেচ্ছ ব্যবহারে সাময়িক ভাবে ব্যথা কমলেও মূল সমস্যাটি রয়ে যায় অবহেলিত। উল্টে ওই ওষুধের জেরে শরীরে তৈরি হতে পারে একাধিক অন্য রোগ।
পেনকিলারের রকমফের
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, পেনকিলার একাধিক ধরনের হয়ে থাকে। প্রতিটির কাজের ধরন, উপাদান ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আলাদা। এই ধরনের ওষুধগুলির মূল রকমফের হল—
- নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগস: ব্যথা, জ্বর ও প্রদাহ কমাতে, হাড়ে চোটের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এই ধরনের ওষুধ।
- প্যারাসিটামল/অ্যাসিটামিনোফেন: জ্বর ও সাধারণ ব্যথার জন্য।
- ওপিওয়েড: মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথা কমাতে অস্ত্রোপচার, কর্কটরোগ, ট্রমা ইত্যাদিতে প্রয়োগ হয়।
- অ্যাডজুভ্যান্ট পেনকিলার: প্রধানত স্নায়বিক ব্যথা (নিউরোপ্যাথিক ব্যথা) কমাতে ব্যবহৃত হয়।
- অ্যান্টি-স্প্যাসমোডিক পেনকিলার: এগুলি সাধারণত মাংসপেশির টান ধরা বা স্প্যাজ়মজনিত ব্যথা উপশম করতে কাজ করে।
চিকিৎসক সুবীর মণ্ডল বলেন, ‘‘এত ধরনের পেনকিলার রয়েছে। চিকিৎসকেরা সমস্যা বুঝে ওষুধ দেন, কিন্তু নিজেরা কিনে খেলে দোকান থেকে মূলত নন-স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগসই দেওয়া হয়। আর সব ধরনের মধ্যে এটিই সবচেয়ে ক্ষতিকর।’’ তিনি জানান, এই ধরনের ওষুধ বেশি দিন ধরে খেলে তা পাকস্থলীর স্বাভাবিক আস্তরণের ক্ষতি করে। তার জেরে পাকস্থলীর ভিতরের দেওয়ালে ক্ষত বা আলসার হতে পারে। এই ধরনের ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি সেবনে কিডনি ধীরে ধীরে পরিশোধন ক্ষমতা হারাতে থাকে। এ ছাড়া, এগুলি রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায় এবং হৃৎপিণ্ডের পেশির কার্যক্ষমতা কমায়। তাই এই ধরনের পেনকিলার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ও নির্দিষ্ট ডোজ়েই খেতে হবে। ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে এর সঙ্গেই অ্যান্টাসিড জাতীয় ওষুধও খেতে হয়।
এ ছাড়া, যে কোনও ব্যথা কমানোর ওষুধই টানা খেয়ে গেলে সেটির উপরে দেহের নির্ভরতা তৈরি হয়। প্রথমে যে ব্যথায় একটি ট্যাবলেট খেলেই কমে যেত, কিছু দিন পরে দেখা যায় তাতে কাজ হচ্ছে না। ব্যথা কমাতে দু’টি বা তিনটি ট্যাবলেট দরকার হচ্ছে। ওষুধ বন্ধ করে দিলে ব্যথা কয়েকগুণ বেশি অনুভূত হতে পারে। আবার মনস্তাত্ত্বিক ভাবেও কেউ এই ওষুধের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারেন। সব ওষুধেরই কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। দীর্ঘ দিন ধরে নিজের ইচ্ছেমতো সেগুলি খেয়ে গেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ, সাধারণ ব্যথায় প্রয়োজনে ওটিসি পেনকিলার খেতে হলে প্যারাসিটামল তুলনায় নিরাপদ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম। সাধারণ জ্বরে যে মাত্রার প্যারাসিটামল লাগে, ব্যথার ক্ষেত্রে সাধারণত তার চেয়ে বেশি মাত্রার প্রয়োজন হয়। তাই দিনে ক’টি প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে, কত দিন ধরে খাওয়া যাবে, তা নিয়েও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শের কোনও বিকল্প নেই।
শিশুদের ক্ষেত্রে সাবধানতা
শিশুদের ক্ষেত্রে পেনকিলার দেওয়ার আগে আরও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ওজন অনুযায়ী ঠিক ডোজ় দেওয়া জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ দেওয়া উচিত নয়। সেই ওষুধ আগে দেওয়া হলেও নয়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে তরল ওষুধ দেওয়া হয় ডোজ় নির্ধারণের সুবিধের জন্য। ওষুধ দেওয়ার পরে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার লক্ষণ যেমন, ঘুম ঘুম ভাব, বমি, র্যাশ, পেট ব্যথা, প্রস্রাব কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তাই ব্যথার সমস্যায় চটজলদি আরামের দিকে নয়, বরং নজর থাকুক সচেতনতায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)