গোড়ার দিকে সর্দির চোটে হাঁচি, নাক বন্ধ। বাজারচলতি নাকের ড্রপ নিয়ে বেশ খানিকটা স্বস্তি, তার পর সর্দি সেরে গেলেও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা কিছুতেই যাচ্ছে না। অগত্যা নেজ়াল স্প্রে বা ড্রপ চলতেই থাকছে... এ ভাবে সপ্তাহ, মাস কেটে যায়, কিন্তু ড্রপ নেওয়ার অভ্যেস যায় না। অনেকের আবার সর্দি ছাড়াই নাক বন্ধের সমস্যা। তিনিও ক্রমশ নেজ়াল ড্রপে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত জানালেন, তাঁর কাছে এই নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নেজ়াল ড্রপের ব্যবহার ছাড়তে না পারা অসংখ্য রোগী আসেন। দীর্ঘ দিন ধরে এ জাতীয় ড্রপ নিতে থাকলে কতটা ক্ষতির সম্ভাবনা? “এটা একটা নেশা। এ বার নেশা ছাড়তে না পারলে যা হয়! এই অভ্যেস অন্যান্য সমস্যা ডেকে আনে। ঘুমের ব্যাঘাত, মনঃসংযোগের অভাব, সারা দিন ক্লান্ত লাগা, ঝিমুনি... এগুলো শুনতে কঠিন রোগ মনে না হলেও যথেষ্ট ক্ষতিকর এবং তা যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে,” বললেন ডা. দাশগুপ্ত। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যে কোনও ওষুধের দোকানে নাকের ড্রপ মেলে। বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে সাধারণ মানুষ তা কিনে দেদার ব্যবহার করেন। দিনসাতেক ব্যবহার করলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু অনেকে মাস, বছর গড়িয়ে গেলেও এর অভ্যেস থেকে কিছুতেই বেরোতে পারেন না।
কোন ধরনের ড্রপ বেশি ক্ষতিকর? “বাজারচলতি অনেক ড্রপে জ়াইলোমেটাজ়োলিন, অক্সিমেটাজ়োলিন থাকে। এগুলো চাইলেই দোকানে পাওয়া যায়। এর ক্ষতিকর দিক না জেনেও মানুষ এগুলো ব্যবহার করে যাচ্ছেন।” এই জাতীয় ড্রপের বদলে ইন্টার নেজ়াল স্প্রে স্টেরয়েড কিংবা স্যালাইন ওয়াটার ব্যবহার করা যায়। এগুলো দীর্ঘ দিন ব্যবহার করলেও সমস্যা নেই। কিন্তু এই স্প্রে বা ড্রপ কাজ করতে সময় নেয়। অনেক ক্ষেত্রে সপ্তাহ লেগে যায়। অন্য দিকে, জ়াইলোমেটাজ়োলিন, অক্সিমেটাজ়োলিন-যুক্ত ড্রপ অনেক দ্রুত স্বস্তি দেয়। ডা. দাশগুপ্তর কথায়, “যেহেতু মানুষ দ্রুত ফল পাচ্ছেন, তাই তাঁরা না জেনে ওই ক্ষতিকর জিনিসগুলোই ব্যবহার করে যাচ্ছেন। ডাক্তারির ভাষায় একে বলা হয়— রাইনাইটিস মেডিকা মেনটোজ়া মানে ওষুধ সংক্রান্ত নাকের সমস্যা। আমি রোগীকে জিজ্ঞেস করি, ক’টা বোতল আছে? অফিস, বাড়ি, ব্যাগ সব জায়গায় এরা একটা করে রেখে দেয়, যাতে দরকার পড়লেই ব্যবহার করতে পারে। এতটাই নেশার বস্তু এটি।”
নেজ়াল ড্রপ নাকের লাইনিং সঙ্কুচিত করে দেয়, এতে নাকটা খুলে যায়। রোগীও আরাম পায়। এ বার অনেক দিন ব্যবহারের ফলে এটাই আবার নাকের লাইনিংটাকে ফুলিয়ে দিয়ে নাক আবার বন্ধ করে দেয়। সাধারণ মানুষ সেটা বুঝতে পারেন না। তাঁরা ভাবেন, নাক বন্ধ হয়ে গিয়েছে ফলে আবার ড্রপ নেন। এটা করতে করতে একটা সাইকল তৈরি হয়, যা থেকে বেরোনো খুব মুশকিল। সাত-দশ বছর ধরে নেজ়াল স্প্রে ব্যবহার করছেন, এমন রোগীও চিকিৎসকের কাছে আসেন। নাক বন্ধের সমস্যা নিয়ে এলে কয়েকটি দিক অনুসন্ধান করে দেখতে হয়। “আমাদের কাছে রোগী এলে খতিয়ে দেখতে হয় কেন নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাকের হাড় বাঁকা, সাইনুসাইটিসের জন্য নাকি এই ড্রপ ব্যবহার করার জন্য? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় ড্রপ বা স্প্রে এর কারণ।” প্রথমে বাজারচলতি ড্রপ বা স্প্রে বন্ধ করতে বলা হয় রোগীকে। বদলে স্যালাইন ওয়াটার জাতীয় ড্রপ দেওয়া হয়। অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ওষুধ দেওয়া হয়।
অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে যায় যে সার্জারি পর্যন্ত করাতে হয়। টারবিনোপ্লাস্টি সার্জারির মূল কারণ এই নাক বন্ধের সমস্যা। ডা. দাশগুপ্তর কথায়, “নেশা ছাড়ানো, অ্যালার্জি ট্রিটমেন্ট সব করার পরেও যখন সুরাহা হয় না, তখন সার্জারির রাস্তায় যেতে হয়। তবে এই সার্জারিতে চিরস্থায়ী সমাধান হয় না। মাইক্রোডেব্রাইডার টারবিনোপ্লাস্টি করা হয়। এতে নাকের টার্বিনেটকে ফোঁপড়া করে দেওয়া হয়। পাশবালিশের তুলো ফেলে দিলে যেমনটা হবে, তেমন ব্যাপার। তবে যাঁরা ড্রপের নেশায় আক্রান্ত তাঁদের উপরে চট করে এই সার্জারি না করাই ভাল। এতে রেজ়াল্ট ভাল হয় না। অপারেশনের পরেও নেজ়াল ড্রপ ব্যবহার করলে সার্জারি কোনও কাজেই দেবে না।”
অনেকের সারা দিন বেশি সমস্যা হয় না, কিন্তু রাতে শোয়ার সময়ে নাক বন্ধ হয়ে যায়। এর ব্যাখ্যায় চিকিৎসক জানালেন, রাতে এসি-তে শোয়া এবং বিছানার ধুলোর কারণে হয়তো এই সমস্যা দেখা যায়। এই ড্রপ ছোটদের জন্যও পাওয়া যায়। কিন্তু তারা নিজে থেকে যেহেতু এটা ব্যবহার করতে পারে না, তাই এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। সর্দি বা নাক বন্ধ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কিছু দিন স্যালাইন ওয়াটার দেওয়া যেতে পারে। রাস্তার ধুলোর কারণে অ্যালার্জির সমস্যায় নাক বন্ধ হয়ে যায়। যাঁদের অ্যালার্জির সমস্যা, তাঁরা মাস্ক ব্যবহার করুন। যোগাসন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করলেও সুরাহা হতে পারে।
কমবয়সি, মাঝবয়সিদের মধ্যেই ড্রপ-স্প্রে নেওয়ার প্রবণতা বেশি। চিকিৎসকদের মতে, নিজের মনকে শক্ত করে জোর করে এই নেশা থেকে বেরোতে হবে। কিছু দিন ড্রপ নেওয়া বন্ধ থাকলে কিন্তু আর সেটির প্রয়োজন পড়ে না। ডা. দাশগুপ্তর মতে, প্রতিটি নেজ়াল ড্রপের বোতলে সর্তকীকরণ দেওয়া প্রয়োজন। খোলা দোকানে এটি যাতে না পাওয়া যায়, সরকারি ভাবেও তা দেখা উচিত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)