Advertisement
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
Ways to help avoid self-harm

নিজেকে শেষ করার ভাবনা মানেই মানসিক দুর্বলতা কি? কী ব্যবস্থা নিলে কাউকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরানো যায়?

মনের দুর্বলতা না কি জুটিয়ে নেওয়া সাহস— নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এই ভাবনার নেপথ্যে কাজ করছে কোন মনস্তত্ত্ব? কেনই বা বাড়ছে আত্মহননের প্রবণতা? সত্যিই কি তা প্রতিরোধ করা সম্ভব?

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:০৯
Share: Save:

ছ’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ছ’বারই বেঁচে গিয়েছেন কোনও এক আশ্চর্য উপায়ে। শেষ বার চিকিৎসকেরা ধরেই নিয়েছিলেন সব বুঝি শেষ। কিন্তু শেষমেশ জীবনের পাল্লাই ভারী হয়। অবসাদের অতল গহ্বর থেকে না চাইতেই ফিরে আসেন প্রৌঢ়া। সভাঘরে বহু মানুষের সমাবেশে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, “ছ’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে পারিনি। আবারও করব সুযোগ পেলে। এই চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় কি কিছু আছে?” গোটা সভাঘর নিস্তব্ধ। পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে তখন কেঁপে উঠেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘সুইসাইড প্রিভেনশন নেটওয়ার্ক’-এর সদস্য, পোড়খাওয়া মনোরোগ চিকিৎসক লক্ষ্মী বিজয়কুমার। এত সপ্রতিভ ভাবে, সকলের সামনে এমন সাহস কি কেউ দেখাতে পারেন?

মনের দুর্বলতা না কি জুটিয়ে নেওয়া সাহস— আত্মহত্যার নেপথ্যে কাজ করছে কোন মনস্তত্ত্ব? কেনই বা বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা? সত্যিই কি তা প্রতিরোধ করা সম্ভব? এই সব নিয়েই কথা বললেন চেন্নাইয়ের মনোরোগ চিকিৎসক লক্ষ্মী বিজয়কুমার। শহরের একটি হোটেলে ‘দ্য ন্যাশনাল কনফারেন্স অন সুইসাইড প্রিভেনশন’ নামে একটি সম্মেলন চলছে। এর দায়িত্বে রয়েছেন মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় ও মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। মনের আঁকাবাঁকা গতিপথকে আতশকাচের নীচে রেখে বিশ্লেষণ করেছেন মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসকেরা।

ভরা সভামঞ্চে যিনি জোর গলায় আত্মহত্যার কথা বললেন, তিনি কিন্তু মনোরোগী নন। সমাজকর্মী হিসাবে কাজ করেন নানা জায়গায়। এই বিষয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথোপকথনের সময়ে মনোরোগ চিকিৎসক লক্ষ্মী বিজয়কুমার বললেন, “মানসিক ব্যাধি আর আত্মহত্যা এক বিষয় নয়। মনের রোগী মানেই যে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেবেন, তা কিন্তু নয়। অবসাদ, উদ্বেগ, একাকিত্ব, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শারীরিক দুর্বলতা— নেপথ্যে অনেক কারণই থাকতে পারে। আবার বাইপোলার ডিজ়অর্ডার, স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডারের মতো ব্যধিও আত্মহত্যার কারণ হতে পারে। দারিদ্র, বেকারত্ব, ঋণ, একাকিত্বের মতো মানসিক আঘাত বা ক্ষতির অভিঘাত নিজের বা সামাজিক পরিবেশগত শক্তিতে সামাল দিতে না পারলে তা খুলে দেয় আত্মহত্যার পথ।”

সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন বয়সি মানুষের কাছে এর অভিঘাত ভিন্ন ভিন্ন। তবে আত্মহত্যার নিয়ামক হতে পারে যে বিষয়গুলি, তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। চিকিৎসক বলছেন, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একটি কথা আছে, ‘টানেল ভিশন’। আত্মহত্যা করবই, এই ভাবনা দৃঢ় ভাবে চেপে বসে মনে। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথটা খুবই জটিল। যেমন, পরীক্ষায় খারাপ ফল হলেই আত্মহত্যা করব, বাবা-মা পছন্দের জিনিস কিনে না দিলেই নিজে শেষ করে দেব, প্রেমিকা না বললে এই জীবন আর রাখবই না— বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা এমন ভাবনা নিয়েই মনোবিদের কাছে আসে। পরীক্ষায় খারাপ ফলের কারণে আত্মহত্যার চেষ্টায় কিন্তু মেয়েরা ছেলেদের থেকে অনেক এগিয়ে।

আত্মহত্যার চিন্তা কিন্তু একদিনে আসে না। দীর্ঘ সময় ধরে তা মনের কোনও গহীন কোণে লালন-পালন করেন অনেকে। দেখা গিয়েছে, ৬ বছর ধরে কেবল ‘আত্মহত্যা করব’ এই ভাবনা ভেবেছেন কেউ। তার পর থেকে শুরু হয়েছে প্রচেষ্টা। অর্থাৎ, ‘আত্মহত্যার প্রবণতা’ ও ‘আত্মহত্যার চিন্তা’ কিন্তু সমান্তরাল ভবেই চলতে পারে। এমন মানুষজনের চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা বা অভিব্যক্তিতে অনেক সময়েই তা প্রকাশ পায়, যা বুঝতে পারেন না বা এড়িয়ে চলেন তাঁরই আশপাশের মানুষজন।

২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে আত্মহত্যার ঘটনা অন্তত ১০ শতাংশ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তা কি আদৌ সম্ভব? সেই প্রচেষ্টা তখনই সফল হবে, যখন সমাজের সব ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা ঠেকানোর মতো আপৎকালীন ব্যবস্থা, প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো থাকবে। লক্ষ্মীর কথায়, “কোমরের হাড় ভেঙে যিনি হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাঁর দ্রুত চিকিৎসার জন্য জরুরি বিভাগ রয়েছে। কিন্তু আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে যিনি হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাঁর দিকে সে ভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে? কখন মনোবিদ আসবেন, সেই অপেক্ষায় রেখে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে।” এটাই হল পরিকাঠামোগত ত্রুটি। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার নানা ভাবে সচেতনতা মূলক প্রচার ও কর্মসূচি চালাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা সর্ব ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হচ্ছে কি না, সেটাই হল আসল ব্যাপার।

মনের অস্থিরতা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ঠিক কোন স্তরে পৌঁছলে একজন আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেন— তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূল্যায়ন হয় না বেশির ভাগ সময়েই। এমনটাই বলছেন মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব। ‘প্রোটেকটিভ মেকানিজ়ম’ বলে একটা কথা আছে, যা স্কুল-কলেজ, পরিবার, হাসপাতাল, কর্মক্ষেত্র— সব জায়গাতেই মানতে হবে। বছর চোদ্দোর একটি মেয়ের কথা বললেন অনিরুদ্ধবাবু। মেয়েটি এক বোতল ফাউন্টেন পেনের কালি খেয়ে ফেলেছিল। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরিবারের লোকজন তো বটেই, স্কুলের বন্ধুরাও পালা করে এসে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছিল, বার বার তার জিভের রং দেখতে চাইছিল। মেয়েটি এতটাই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যে পরদিনই হাসপাতালের বাথরুমে গিয়ে ফিনাইল খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও মেয়েটির মনের পরিস্থিতি বুঝে তাকে আগে থেকেই সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেননি। খামতি রয়ে যাচ্ছে এখানেই।

গণমাধ্যমেরও কি বিশেষ ভূমিকা নেই? মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় এই ব্যাপারে আলোকপাত করলেন। তাঁর কথায়, “গণমাধ্যমে নিয়মিত যে ভুল চর্চাগুলোর অবতারণা করা হয়, সেগুলোর সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করা দরকার। এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে প্রথমেই যে অনুরোধ করতে চাইব, ‘আত্মহত্যা করেছেন’–এর পরিবর্তে ‌‘আত্মহত্যায় মৃত্যু ঘটেছে’ লেখা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। বাক্যগঠনে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ক্যানসার বা হার্ট অ্যাটাক যেমন করানো যায় না, ঘটে যায়, আত্মহত্যাও ঠিক তাই। তেমনই ফাঁসের ছবিকে আত্মহত্যার প্রতীকী ছবি হিসেবে ব্যবহার করার মধ্যে মৃত্যুর উপায়টাকে নিয়ে অকারণ সেনসেশনের এক রকমের অতিসরলীকরণ আছে। তার নেপথ্যে মৃত্যুর কারণটা ছোট হয়ে যায়।” আত্মহত্যা কারণ নয়, উপায় মাত্র। দারিদ্র, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, জাতপাত ও বর্ণব্যবস্থার চাপ, লিঙ্গহিংসা, শিক্ষাক্ষেত্রে বা কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাশার চাপ, সম্পর্কের টানাপোড়েন বা গার্হস্থ্য হিংসা— কারণ কিন্তু এগুলিই। তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের পিছনে সঠিক কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ধারণ করতে হলে আত্মহত্যা সম্পর্ক তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আরও পরিষ্কার বোঝাপড়া থাকা প্রয়োজন।

তা হলে কী করণীয়?

আত্মহত্যা কিন্তু নিবারণযোগ্য। প্রশাসনের, সমাজের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার দরকার আছে। আত্মহত্যার উপকরণ যাতে সহজপ্রাপ্য না হয়, সে ব্যাপারে প্রশাসনিক নজরদারির প্রয়োজন।

কীটনাশক, আগ্নেয়াস্ত্র, সংশ্লিষ্ট ওষুধ বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ দরকার। রাসায়নিক কীটনাশকের বদলে যদি জৈব কীটনাশকের প্রয়োগ বাড়ে, তা হলে কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকা যায়। অতি বিষাক্ত কিছু কীটনাশক বর্জনে সুফল পেয়েছে কেরল। এখানেও ওই পদ্ধতি অনুসরণ করলে গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার ঘটনা কমবে।

প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আত্মহত্যা নিবারণে আপৎকালীন পরিষেবা থাকা দরকার। তার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রোটোকলও থাকতে হবে।

সরকারের কিছু নিয়মকানুন ও নির্দেশিকা থাকাও জরুরি। প্রতি রাজ্যের সরকারেরই উচিত সেই রাজ্যের হিসেবে আলাদা আলাদা প্রোটোকল তৈরি করা। ২০১৫ থেকে ২০২০-র মধ্যে এ রাজ্যে আত্মহত্যা কমেছে দুই শতাংশের বেশি (প্রতি লাখে)। কিন্তু কী ভাবে কমল, আরও কমাতে গেলে কোন কোন কর্মসূচিগুলি বেশি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকাও জরুরি।

পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-বন্ধুদের সহমর্মী হয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে। মনের অস্থিরতা, অবসাদ বাড়লেই তার সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। অবসাদ চেপে রাখলেই তা পরবর্তী সময়ে গিয়ে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Mental Health Suicidal Tendency Attempt to Suicide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy