সকালে খালিপেটে গরম জলে পাতিলেবুর রস। দু’টি উপকরণ, হাজার গুণ। এমনই তো শোনা যায়। বিশেষ করে যাঁরা ওজন ঝরাতে চান, তাঁদের জন্য নাকি উপযুক্ত। এক সপ্তাহ গরম জলে লেবু চিপে খেলে ক্যালোরি ঝরবে, জলের ঘাটতি মিটবে, শরীর থেকে দূষিত পদার্থ সব বেরিয়ে যাবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, হজমশক্তি উন্নত হবে, পেট ফাঁপার প্রবণতা কমবে, ত্বক কোমল হবে, মনোনিবেশের ক্ষমতা বাড়বে। সমাজমাধ্যমে অসংখ্য ভিডিয়োয় এমনই সব উপকারিতার তালিকা দেওয়া হয়।
আদৌ কি এতই উপকারী গরম জলে লেবুর রস?
রোজ সকালে উঠে গরম জলে লেবুর রস মিশিয়ে খেলেই মনে হতে পারে, ওজন কমছে, শরীর চাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আদতে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত নয়।
কোন কোন উপকারিতার কথা বলা হয়? সেগুলির কতটা সত্য?
শরীরে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি: এক গ্লাস ভর্তি গরম লেবুর জল খাচ্ছেন সকালে উঠে। শরীরে জলের পরিমাণ তো বৃদ্ধি পাচ্ছে বটেই। উপরন্তু সকালের প্রথম খাবার (পানীয়) যদি এটি হয়, তা হলে আরওই ভাল। সারা রাতে এক বারও ঘুম থেকে উঠে জল খাননি, ফলে জলের ঘাটতি হয়েছে নিশ্চয়ই। সে ক্ষেত্রে এক গ্লাস লেবুর জল খেলে উপকার মিলবেই। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা থেকে গাঁটের নমনীয়তা বাড়ানো এবং ঘাম বা প্রস্রাবের মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ বার করে দেওয়া, ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বেশ কার্যকরী। শরীরে জলের ঘাটতি কমানোয় অবদান রয়েছে বলে ত্বক ভাল থাকে। ফুরফুরে থাকে মেজাজও। কাজে মনোযোগ বাড়ে। পুষ্টিবিদেরাও এই দাবিগুলি সমর্থন করেন।
কিন্তু ভেবে দেখুন, যা যা উপকারিতার কথা বলা হল, তার সবই কি শুধু জল খেলে মিলত না? তাই কিছু পুষ্টিবিদের বক্তব্য, লেবুর জলে বিশেষ কিছুই নেই। আপনি একই উপকার পেতেন এক গ্লাস জল বা ভেষজ চা বা এক কাপ কফি খেলেও। আসলে সকালে উঠে যে কোনও পানীয়ে চুমুক দিলেই শরীরে জলের ঘাটতি কমতে পারে। আর হাইড্রেট করলে এই সব উপকারিতা মিলবেই।

লেবু বা সাইট্রাস ফল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ছবি: সংগৃহীত।
হজমক্ষমতা বৃদ্ধি: পাচনক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে জল বা যে কোনও তরল (অবশ্যই কোল্ড ড্রিঙ্ক প্রশ্নের মুখে পড়ে)। জলে লেবু মেশান বা না মেশান, হজমের ক্রিয়াকে সক্রিয় রাখার জন্য তরল অপরিহার্য।
২০২০ সালে তুরস্কে ৪,৫০০ জন প্রাপ্তবয়স্ককে নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, যাঁরা দিনে ৮ গ্লাসের বেশি জল পান করেন, তাঁদের কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি ২৯ শতাংশ কম ছিল। যাঁরা ৪ গ্লাসের কম জল খান, তাঁদের তুলনায়। এই গবেষণা হয়েছে কেবল জল দিয়ে। জলের জায়গায় লেবুর জল দিলে ফলাফল কী হত, বেশি ভাল হত, না কি খারাপ, তা জানা যায়নি। তবে লেবুর রস পাকস্থলীর অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে খাবারের কণাগুলি ভেঙে গিয়ে হজম হয় দ্রুত। এটি প্রমাণিত রয়েছে ২০২২ সালের একটি গবেষণায়। দেখা গিয়েছিল, পেট খালি করার গতিকে বাড়িয়ে দিতে পারে লেবুর জল। কিন্তু খুব ছোট পরিসরে গবেষণা হয়েছিল বলে ফলাফল নিয়ে খানিক ধন্দে রয়েছেন চিকিৎসকেরাই। তবে বয়স্কদের জন্য লেবুর জল উপকারী। বয়স বাড়ার সঙ্গে পেটে অ্যাসিডের পরিমাণ কমে যায়। যে কারণে হজমে সমস্যা হয়। সে ক্ষেত্রে লেবুর সাইট্রিক অ্যাসিড হজমে সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে লেবু। এ দাবিতে সামান্য সত্যতা রয়েছে। লেবুতে ভিটামিন সি থাকে প্রচুর পরিমাণে। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে পারে, সে কথা ঠিক। কিন্তু তাই বলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করলেই যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মজবুত ও জোরদার হবে, তার কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই। ৬০টির বেশি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা দিনে ২০০ মিলিগ্রাম বা তারও বেশি ভিটামিন সি গ্রহণ করেন, তাঁদের সর্দিকাশি অন্যদের তুলনায় কম হয় বা তাড়াতাড়ি সারে, এমন নয়। সবই সমান।
ওজন হ্রাস: রোজ চিনি দেওয়া কফি, চিনি দেওয়া চা খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে? তা হলে পরিবর্তে গরম লেবুর জল খান সকালে উঠে। শরীরে চিনির পরিমাণ কম গেলে ওজন কমতে পারে। তবে গরম লেবুর জল নিজে থেকে ওজন কমাতে পারে বলে কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই।
আরও পড়ুন:
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে: প্রমাণের ভিত্তি দুর্বল হলেও কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লেবু বা সাইট্রাস ফল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, টাইপ ২ ডায়াবিটিসের ঝুঁকি কমায়।
গরম জলে লেবু খেলে কি কোনও বিশেষ লাভ হয় না?
সকালে খালিপেটে ভর্তি ভর্তি চিনি মেশানো কফি বা চায়ের বদলে গরম জলে লেবু মিশিয়ে খেলে অবশ্যই উপকার রয়েছে। জাদুকরী পানীয় না হলেও লেবুর জলে কোনও ক্ষতি নেই। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে একেবারে খালি পেটে লেবুর সাইট্রিক অ্যাসিড খেলে আবার অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা অম্বলের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে খেলে সবচেয়ে ভাল।