E-Paper

বালাই ষাট!

ষাটের পরেও বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করা যায়। প্রেম, ভালবাসা, বন্ধুত্বের যে কোনও বয়স হয় না।

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২৫ ০৯:১৫

ভালবাসার যদি কোনও বয়স না থাকে, তা হলে বিয়ের কেন বয়স থাকবে? দুটো মানুষের একসঙ্গে পথচলার একটা প্রতিষ্ঠান বলা হয় বিয়েকে। সেই পথচলা জীবনের যে কোনও পর্যায়েই শুরু হতে পারে। যেখানে বয়সকালে মানুষের জীবনে একাকিত্বই ক্রমশ সঙ্গী হয়ে ওঠে, সেখানে মনের মতো একজন সঙ্গী নাহয় রইল পাশে। সেখান থেকেই নতুন সম্পর্কে ইচ্ছুক সিনিয়র সিটিজ়েনদের বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন পুনের এক স্বেচ্ছাসেবী মাধব দামলে।

জীবনসায়াহ্নে এসেও নতুন বন্ধু

শিশু ও মহিলাদের নিয়েই প্রথমে কাজ করত মাধবের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কিন্তু সেই কাজের মাধ্যমেই ক্রমশ দেশের প্রবীণ নাগরিকদের কাছে আসেন মাধব। তাঁদের নিয়ে শুরু করেন তাঁর নতুন অভিযান ‘হ্যাপি সিনিয়রস’। বয়স্কদের বন্ধু খুঁজে দেওয়া, তাঁদের বিয়ের ঘটকালি করা, লিভ-ইন সম্পর্কে যেতে চাইলে আইনি সহযোগিতা করার মতো সব দিক দিয়ে সাহায্য করেন তিনি। তাঁর সংস্থার উদ্যোগে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৫০জন প্রবীণ নাগরিক নিজের মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছেন, অনেকে বিয়ে করে নতুন সংসারও শুরু করেছেন।

পথচলার শুরু কী ভাবে?

মাধব বললেন, “আমাদের দেশে ষাটেই বেশির ভাগ চাকুরিরতদের কর্মজীবন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু মানুষের জীবনীশক্তি তো ফুরিয়ে যায় না। সে বাঁচার রসদ চায়। কিন্তু কর্মজীবন শেষ হয়ে গেলে সেই জগতের বন্ধুবান্ধব, পরিচিত বৃত্ত কমতে থাকে। অনেকে জীবনসায়াহ্নে এসে একা হয়ে যান, স্বামী বা স্ত্রীকে হয়তো হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। তখন সেই মানুষটিকে যে কী পরিমাণ একাকিত্ব গ্রাস করে, তা ওই বয়সে না পৌঁছলে বোঝা যায় না। প্রথম প্রথম যখন বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করতাম, প্রবীণদের একাকিত্ব দেখে আমি নিজেই মুষড়ে পড়তাম। তখনই মনে হল এঁদের জন্য যদি কিছু করা যায়।” সিনিয়র সিটিজ়েনদের জন্য গেট-টুগেদার বা নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে শুরু করেন তিনি। সেখানে এসে তাঁরা মনের কথা বলতে শুরু করেন। তাঁদের ভিতরের সুপ্ত প্রতিভাও বেরিয়ে আসে। মনের মানুষও খুঁজে পান অনেকে।

পথের বাধা

  • কিন্তু এই পথও খুব মসৃণ নয়। বয়স্কদের নতুন সম্পর্ক তৈরির পথের কাঁটা অনেক সময়েই তাঁর কাছের জন। সন্তান, ভাইবোন, পরিবারই অনেক সময়ে মেনে নিতে পারেন না ষাট-পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এসে নতুন সম্পর্কে জড়ালে। জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী বললেন, “ষাটের পরে এখন গড় আয়ু আরও ২০ বছর বেড়ে গিয়েছে। সেখানে ষাটের পরেও অনেকটা জীবন বাকি। সেই জীবনে নতুন করে স্বপ্ন দেখতেই পারেন একজন। আমি এমন এক ভদ্রমহিলাকে চিনি, যিনি অনেক বয়সে এসে আবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। অনেক কম বয়সে তিনি স্বামীকে হারিয়েছিলেন। মেয়েকে বড় করতে করতে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর কথা ভাবেননি। কিন্তু মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরে তিনি যখন মনের মানুষ খুঁজে পান, বিয়ে করতে চান। তাঁর মেয়েও রাজি হয়ে যায়। কিন্তু সেই ভদ্রমহিলার বিয়ের পরেই তাঁর মেয়ে অবসাদে চলে যায়। সে মায়ের নতুন সম্পর্ক মেনে নিতে পারে না।” আসলে মা-বাবাকে আমাদের সমাজে দেবত্বের স্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের পাশে বাবা হিসেবে বা বাবার পাশে মা হিসেবে আর কাউকে মেনে নিতে পারে না তাঁর সন্তানরা।
  • ইন্দ্রাণী আরও বললেন, “বিদেশে বয়স্ক মানুষদের ভালবাসা, প্রেম, যৌনজীবন যতটা খোলামেলা ভাবে আলোচিত, আমাদের দেশে তা নয়। ফলে মা বা বাবা যে একজন মানুষ, তাঁদেরও কিছু চাহিদা আছে, তা ভাবতেই শেখেনি ছেলেমেয়েরা। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, এই বয়সটা তো নাতি-নাতনিদের নিয়ে কাটানোর। কিন্তু তাঁর মা-বাবা সেটা না চেয়ে শেষ জীবনটা অন্তত নিজের মতো উপভোগ করতে চাইতে পারেন, এটা অনেকেই ভাবতে পারে না।”
  • সম্পত্তির ভাগ নিয়েও রয়েছে সমস্যা। মাধব বললেন, “প্রবীণ জুটির দু’জনেরই যদি সন্তান থাকে, তা হলে সম্পত্তি কী ভাবে ভাগ হবে, তা নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়। তখনও তাঁদের আইনি সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।”
  • আর রয়েছে পরিবার, পরিজন ও বন্ধুবৃত্তে কোণঠাসা হওয়া। অনেক সময়েই বয়স্করা নতুন সম্পর্কে জড়ালে তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যরা দূরে সরে যান। পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাঁদের এড়িয়ে যাওয়া হয়। মাধব বললেন, “কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা একা মাসের পর মাস বাড়িতে থাকেন। বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ, তা হয়তো ফোনে। কিন্তু সেই প্রবীণ মানুষটি নতুন সম্পর্কে জড়ালে সেই বন্ধু বা আত্মীয়রা যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। ফলে অনেকে আবার বিয়েতে জড়াতে চান না। অনেকে লিভ-ইনও করেন। তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ফলে অনেকে মাঝেমাঝে দেখা করেন, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখেন।” একটা সঙ্গী অন্তত পান, যে তাঁর মনের কথা শুনবে।
  • এখানে আর্থিক স্বাধীনতাও একটা উল্লেখযোগ্য দিক বলে জানালেন মাধব ও ইন্দ্রাণী দু’জনেই। যে সব সিনিয়ররা মোটামুটি আর্থিক ভাবে স্বাধীন ও সচ্ছল, তাঁদের জীবনে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক সহজ। কিন্তু যে সব মা-বাবা সন্তানের উপরে নির্ভরশীল বা সে ভাবে সঞ্চয় নেই, তাঁদের বার্ধক্য আরও দুর্বিষহ। “সেখানে নতুন করে জীবন শুরু করা তো দূরের কথা, অহেতুক সন্তানের অ্যাবিউজ়ের শিকারও হন। ফলে মনের সঙ্গীকে খুঁজে পেলেও সে কথা বাড়িতে বলতে পারেন না। তবে আমাদের দেশে এখন রিটায়ারড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনস, সিনিয়র সিটিজেনস অর্গানাইজ়েশনের মতো সংস্থার মাধ্যমে অনেক প্রবীণই জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছেন। নতুন কাজ পাচ্ছেন, ফলে অর্থবল থাকছে। মনের খোরাক পাচ্ছেন। নিজের জন্য সিদ্ধান্তও নিতে পারছেন। আর কাজ করতে গিয়ে দেখেছি একজন আর্থিক ভাবে স্বাধীন, কর্মক্ষম মানুষের উপরে বাকিরা অতটা জোর খাটায় না বা অপমান করে না,” বলে জানালেন বার্ধক্যবিজ্ঞানী ইন্দ্রাণী।

প্রবীণরা নতুন সম্পর্কে জড়াতে পারে, এটা তাঁদের মানবাধিকারের অন্তর্গত। আইনত সম্পর্কস্থাপনে কোনও বাধা না থাকলেও আমাদের সমাজের বাধা এ ক্ষেত্রে অনেক বড়। বয়স্কদের জীবন সৃজনশীল ভাবে গড়ে তুলতে, সুখী বার্ধক্য সুনিশ্চিত করতে সমাজের চিন্তাধারা পাল্টানো দরকার। আর সেই কাজ শুরু করতে হবে এই প্রজন্মের ইয়ং অ্যাডাল্টদের। মনে রাখতে হবে, নবীন থেকে প্রবীণ... এই সফরের দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

happy life

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy