দই দিয়ে বেশ কষিয়ে মাছের কালিয়া বা মাংসের কষা না খেলে বাঙালির ঠিক তৃপ্তির ঢেকুর ওঠে না। আবার রবিবাসরীয় কচি পাঁঠার ঝোলে কয়েক টুকরো গোলপানা আলু না ভাসলে মন আনচান করেই। বাড়ির বয়স্ককে সকাল সকাল কলা দিয়ে জমিয়ে চিঁড়ে বা কর্নফ্লেক্স মেখে দিয়ে ভাবেন, বেশ পুষ্টিকর খাবারই খাওয়াচ্ছেন। আবার পিৎজ়ার উপর মোটা করে চিজ়ের প্রলেপের সঙ্গে কুচি কুচি চিকেনের মাখামাখি না হলে সান্ধ্য আড্ডাই পানসে হয়ে যায়। এই সব চেনা খাবারের মিলমিশকে এখন অস্বাস্থ্যকরই বলছেন পুষ্টিবিদেরা। খাবারে খাবারে সখ্য গড়ে তোলা সহজ নয়, এর নির্দিষ্ট মাপকাঠি আছে। একটির সঙ্গে অন্যটি খেয়ে ফেললেই হল না, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। আর এই বিষয়টি নিয়েই এখন বিশ্ব জুড়ে মাতামাতি হচ্ছে।
খাবারে খাবারে সখ্য
কোন খাবারের সঙ্গে কোন খাবারের মিলমিশ পেটের জন্য ভাল আর কোন কোন খাবার জুটি বাঁধলে তা ধুন্ধুমার বাধাতে পারে, সে নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। আর একেই ‘ফুড কম্বিনেশন’ বলছেন পুষ্টিবিদেরা। সোজা কথায়, কোন খাবারের সঙ্গে কোনটি মিশিয়ে খাবেন আর কোনটি নয়, তার বিস্তারিত তালিকা তৈরি হয়েছে। এতে কিন্তু বাঙালির অতি প্রিয় আলুসেদ্ধ-ভাতকে 'ভাল'র তালিকায় রাখা হয়নি। কারণ দু’রকম কার্বোহাইড্রেট একসঙ্গে খেলেই তারা পেটে গিয়ে গোল বাধাবে, ক্যালোরিও বাড়বে। ভাতের সঙ্গে শাকপাতার তরকারি বা সব্জি দিয়ে স্যুপই ভাল।
ভাল খাবারের জুটি বাঁধল কারা?
‘ফুড কম্বিনেশন’ নিয়ে ভোজনরসিকেরা পড়েছেন মহা সমস্যায়। পাউরুটি দিয়ে চিকেন খেলে ক্ষতি, আবার শসার স্যালাডে লেবু খেলেই অম্বলের ভয়। তা হলে ভালটা কী?
আরও পড়ুন:
এই বিষয়ে পুষ্টিবিদ শম্পা চক্রবর্তীর মত, দই দিয়ে বা দুধ দিয়ে মাছের কালিয়া পেটের জন্য ঠিক নয়। বরং জিরেবাটা দিয়ে মাছের ঝোলই ভাল। আবার দই-ওট্সের সঙ্গে ড্রাই ফ্রু্ট্সের বদলে আপেল, বেদানা খাওয়া ভাল। কলাতে অম্বল না হলে তা-ও চলতে পারে। তবে টক জাতীয় ফল নৈব নৈব চ।
ভাত বা চিঁড়ের সঙ্গে আলু মোটেই চলবে না, বদলে নানা রকম শাকপাতা, সব্জি দিয়ে খাওয়া যাবে। পিৎজ়া ব্রেডের সঙ্গে মাংস আর চিজ় খেলেই অম্বল অবধারিত। আমেরিকায় পিৎজ়ার সঙ্গে টুনা মাছ খাওয়ার চল হয়েছে অনেক জায়গায়, এই ‘কম্বিনেশন’ ভাল বলেই মনে করছেন পুষ্টিবিদেরা।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণাও রয়েছে ‘ফুড কম্বিনেশন’ নিয়ে। সেখানে ভাল খাবারের তালিকাটা ঠিক কী রকম? পাউরুটির সঙ্গে পিনাট বাটারই ভাল, আবার দইয়ের সঙ্গে বেরি জাতীয় ফল পুষ্টিকর। পালং শাকের সঙ্গে ডিম খেয়েছেন কখনও? এই মিলমিশ কিন্তু ভালর দলেই পড়ে। আবার গাজর খেতে হলে তা শসার সঙ্গে নয় বরং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট আখরোট বা অলিভ অয়েলের সঙ্গে খাওয়াই ভাল। ব্রকোলি দেখলে যদি নাক সিঁটকান, তা হলে টম্যাটোর সঙ্গে স্যুপ বানিয়ে খান। দুই অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট মিলেমিশে শরীরের জোর বাড়াবে কয়েক গুণ।
বাঙালির ‘ফুড কম্বিনেশন’
বাঙালি হেঁশেলে খাবারের মিলমিশ নিয়ে তেমন চর্চা হয় না। মা-ঠাকুমারা ‘ফুড কম্বিনেশন’ বুঝে মোটেই রাঁধবেন না। তাই সে ক্ষেত্রে হালকা কিছু নিয়ম মানা যেতে পারে। যেমন মুরগি বা পাঁঠার মাংস অথবা মাছের সঙ্গে এমন সব্জি খেতে হবে, যাতে স্টার্চের মাত্রা কম। তাই আলু নয়, বরং সবুজ সব্জি খাওয়া যেতে পারে। আলু দিয়ে মাছের ঝোল না খেয়ে বরং ঝিঙে, পটল, পেঁপের মতো সব্জি দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। মাংসের ঝোলে পেঁপে চলতে পারে।শুনলে ভাল লাগবে, পেঁয়াজ বা রসুন কিন্তু উত্তম ‘ফুড কম্বিনেশন’। প্রোবায়োটিকের সঙ্গে প্রিবায়োটিক মিলে গেলে অন্ত্রের উপকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলি আরও পরিপুষ্ট হবে।
জলের ভাগ বেশি এমন সব্জি বা ফল, যেমন শসা, তরমুজের সঙ্গে অন্য কিছু খেলে হজম হবে না। শসার সঙ্গে লেবুর রস খেলে তা হজম হতে অনেক বেশি সময় লাগবে।
দুধের সঙ্গে ঘি, মাখন, হলুদ, বিভিন্ন রকম বাদাম, বীজ, খেজুর, কিশমিশ খাওয়া যেতে পারে, তবে ফল নয়।
দুধ ও দই একসঙ্গে কখনওই মেশাবেন না। আবার ঘরে পাতা টক দইয়ের সঙ্গে গ্রিক ইয়োগার্টও মেশাতে যাবেন না। এই মিলমিশ অ্যালার্জি জনিত রোগের কারণ হতে পারে। ফলের সঙ্গে বাদামের দুধই পুষ্টিকর।