মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবার প্রকোপে চিন্তা বেড়েছে কেরলে। এ দেশে এই রোগ নতুন নয়। তবে অতীতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই কম ছিল। গত এক বছরে কেরলে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। ইতিমধ্যে মারাও গিয়েছেন বেশ কয়েকজন। বিরল এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বঙ্গেও। চিকিৎসকদের ধারণা এর পিছনে অনেকটাই দায়ী বদলে যাওয়া আবহাওয়া।
ব্রেন ইটিং অ্যামিবা কী?
জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল বলছেন, “এটি মূলত এক ধরনের আদ্যপ্রাণী (প্রোটোজ়োয়া) অসুখ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম নিগ্লেরিয়া ফ্লোরেরি। স্থির ও বদ্ধ জলে এই প্রোটোজ়োয়ার বাস, যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। এই জলে স্নান করা, সাঁতার কাটা কিংবা চোখ-মুখ পরিষ্কার করার সময়ে এই এককোষী প্রাণী নাকের উপরের ভেজা অংশ অলফ্যাক্টরি প্লেট থেকে দেহে প্রবেশ করে ও অলফ্যাক্টরি নার্ভ ধরে সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। তার পরে মস্তিষ্কের ধারক গ্লায়াল সেল কুরে কুরে খেতে থাকে। তার জন্যই এর অন্য নাম ‘ব্রেন ইটিং অ্যামিবা’। একে প্রাথমিক ভাবে বলে নিউরোগ্লিয়াসিস বা প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (পিএএম)।” মাটিতেও বেঁচে থাকতে পারে এই এককোষী জীব।
সংক্রমণের ভয় রয়েছে?
জলে এই ব্যাক্টিরিয়ার বাস হলেও, নদী বা সমুদ্রের মতো বহমান জলে ভয় নেই। পুকুর, হ্রদ, বদ্ধ জলাশয়, উষ্ণ প্রস্রবণ, সুইমিং পুলের জলে মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবার বাস। শিল্পাঞ্চলের কাছাকাছি জলেও দেখা মেলে। বাড়ির জলের ট্যাঙ্কেও থাকতে পারে এই অ্যামিবা। উষ্ণ পরিবেশে এই ব্যাক্টিরিয়া দ্রুত নিজেদের কোষ বিভাজন করে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোনও ব্যক্তি নিগ্লেরিয়া ফ্লোরেরিতে আক্রান্ত হলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে, যা এই ব্যাক্টিরিয়ার বিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। নিউরোলজিস্ট ডা. মনোজ কুমার মাহাতো বলছেন, “ড্রপলেট কিংবা আক্রান্তের স্পর্শ থেকে এই রোগ ছড়ায় না। নাক ছাড়া, মুখ, চোখ, কান কিংবা অন্য কোনও অঙ্গ দিয়ে এই অ্যামিবা শরীরে প্রবেশ করতে পারে না। খেয়াল রাখতে হবে, একই জলে স্নান করা একাধিক ব্যক্তির মধ্যে একজনের শরীরে যদি এই অ্যামিবার সন্ধান মেলে, তবে বাকিদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
উপসর্গ কী থাকে?
ডা. মাহাতো জানালেন, সাধারণ ভাইরাল ফিভার বা মেনিনজাইটিসের মতো এই রোগের ক্ষেত্রেও জ্বর, মাথা ব্যথা, বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে তার মাত্রা বেশি হয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু না হলে মাঝেমধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক আচরণ করা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, ঝাপসা দৃষ্টিশক্তির মতো সমস্যাও হয়। ঠিক সময়ে এ রোগের চিকিৎসা শুরু না হলে ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারেন। ডা. মণ্ডল বলছেন, “এই প্রোটোজ়োয়া আক্রমণের পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ব্যক্তির দেহে লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে থাকে এবং চিকিৎসার অভাবে ১৪ দিনের মধ্যে মৃত্যুও ঘটতে পারে।”
চিকিৎসার জন্য
অ্যামিবার সংক্রমণ ঠিক সময়ে চিহ্নিত করা গেলে চিকিৎসা সম্ভব। অ্যাজিথ্রোমাইসিন, রিফাম্পিসিন-এর মতো অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধ দ্রুত কাজ করে। তাতে কাজ না হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে সরাসরি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শিরায় পৌঁছে দেওয়া হয় অ্যান্টি-ফাঙ্গাল। উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ দেন চিকিৎসকেরা। কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রদাহ বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছলে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও দেওয়া হয়।
ভয়ের কারণ রয়েছে কি?
উপসর্গ ও পরিণতি প্রাথমিক ভাবে ভীতি ধরালেও, ডা. মাহাতো বলছেন, “অধিকাংশ মানুষের শরীরে এ রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। যাদের কোনও কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে ভয় থেকে যায়।” অ্যামিবার সংক্রমণে স্নায়ুতন্ত্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সকলের ক্ষেত্রে যে এই রোগ প্রাণঘাতী হবে এমন নয়।
সতর্কতা
জল যেন কোনও ভাবেই নাক দিয়ে না ঢোকে। এখন পুকুর বা বদ্ধ জলাশয়ের জলে স্নান না করাই ভাল। সুইমিং পুলের জল নিয়ম মেনে ক্লোরিন প্রয়োগ করে জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক। সাবধান থাকতে সাঁতারের সময়ে নাকের ক্লিপ ব্যবহার করুন। উষ্ণ প্রস্রবণের জল গরম হওয়ায় এই মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা সহজে থাকতে পারে। তাই অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
চিকিৎসক মনোজ বলছেন, প্রাণঘাতী অ্যামিবার সংক্রমণেচলতি বছর কেরলে আক্রান্তেরসংখ্যা পৌঁছেছে ৬৯ জনে। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। অর্থাৎ ৫০ জনকে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে। এ রাজ্যেও সুস্থতার হার বেশি। তাই অযথা ভয় না পেয়ে জ্বর হলে দোকান থেকে ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)