বয়স ধরে রাখতে গ্লুটাথিয়ন ট্রিটমেন্ট করাচ্ছিলেন অভিনেত্রী শেফালি জ়রিওয়ালা। দিন কয়েক আগে মাত্র ৪২ বছর বয়সে আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এ ধরনের বিউটি ট্রিটমেন্টের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ত্বক বিশেষজ্ঞ সন্দীপন ধর বলছেন, “গ্লুটাথিয়ন নিষ্প্রাণ ত্বকে ফের তারুণ্যের জেল্লা এনে দিতে পারে। বয়সকে আটকে রাখতে পারে। এককথায়, সৌন্দর্যের সহজ রাস্তা খুলে দেয় গ্লুটাথিয়ন। রুপোলি পর্দার ব্যক্তিদের তাই এ ধরনের চিকিৎসায় বরাবরই আগ্রহ বেশি। আর তাঁদের দেখাদেখি সে রাস্তায় এখন পা বাড়াচ্ছেন বহু সাধারণ মানুষ, বিশেষত মধ্যবয়সি মহিলারা।”
কী এই গ্লুটাথিয়ন?
প্রচণ্ড রোদে নিয়মিত ঘোরাঘুরি, কম অক্সিজেন সমৃদ্ধ এলাকায় দীর্ঘ সময় থাকা, পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া, অতিরিক্ত পরিশ্রম... নানা কারণে আমাদের শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি হয়। গ্লুটাথিয়ন এই স্ট্রেস কমায়। এ আদতে এক ধরনের ননএনজ়াইম অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, যা আমাদের দেহকোষেই তৈরি হয়। অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট শরীরের জন্য ভাল। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া, রাত জাগা, ধূমপান ও মদ্যপানের ফলে আমাদের শরীরে এর মাত্রা কমতে থাকে। সেই মাত্রা বাড়িয়ে ত্বকের জেল্লা ফেরায় গ্লুটাথিয়ন। তিন রকম অ্যামাইনো অ্যাসিড— গ্লুটামেট, গ্লাইসিন ও সিস্টাইন নিয়ে গ্লুটাথিয়ন তৈরি। এই তিন অ্যামাইনো অ্যাসিডই আসলে এক এক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। একে অ্যান্টি এজিং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টও বলে। ডা. ধর বলছেন, “অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ডায়েট বা ডিটক্স ওয়াটারেও কিন্তু শরীরে এই ননএনজ়াইম অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট— গ্লুটাথিয়নের পরিমাণ বাড়ে।”
পদ্ধতি
বিউটি পার্লার বা সালঁগুলোয় এখন যে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট বা স্কিন লাইটনিং ফেশিয়াল করা হয়, তাতেও গ্লুটাথিয়ন দেওয়া হয়। বহু সানস্ক্রিনেও গ্লুটাথিয়ন থাকে। ওষুধ, ইঞ্জেকশন, আইভি ড্রিপ, সাবলিঙ্গুয়াল স্প্রে, ইনহেলার, ক্রিম বা সেরাম— যে কোনও ভাবেই গ্লুটাথিয়ন থেরাপি করানো যায়। পদ্ধতি অনুযায়ী থেরাপির ডোজ় ও সময়সীমা বদলায়। ডোজ়, নেওয়ার পদ্ধতি বা সময়সীমায় ভুল হলে প্রাণের ঝুঁকি থাকে, সম্ভবত যা শেফালির ক্ষেত্রে ঘটেছিল। ইনহেলারে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছয় গ্লুটাথিয়ন। তবে ক্রিম বা সেরাম ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ। এ পদ্ধতিতে ফলাফল পেতে সময় লাগে, তবে ঝুঁকি থাকে না।
- ইঞ্জেকশন বা ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ: সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে। সপ্তাহ কয়েকের মধ্যেই ফলাফল দেখা যায়।
- ক্যাপসুল: সবচেয়ে প্রচলিত ও কার্যকর পদ্ধতি। ইঞ্জেকশন বা আইভি ড্রিপের তুলনায় শোষণের হার কম। কিন্তু দ্রুত কাজ হয়।
- সাবলিঙ্গুয়াল স্প্রে: জিভের নীচে স্প্রে করতে হয়। ওষুধ কিংবা ইঞ্জেকশনের তুলনায় দ্রুত শোষণ করতে পারে শরীর। তাই এ ক্ষেত্রে তুলনায় ডোজ় কম ব্যবহার করা হয়। অধিক সতর্কতাও জরুরি।
এর উপকার কী?
মেলানিন উৎপাদন কমে, দাগ-ছোপ হালকা হয়। বয়স বাড়লে আমাদের শরীরে বিভিন্ন কোষের ক্ষয় হয়। গ্লুটাথিয়ন কোষের সেই বয়সজনিত ক্ষয়কে প্রতিরোধ করে। লিভারের যত্ন নেয়, শরীরকে ডিটক্সিফাই করে। লিভার সংক্রান্ত সমস্যা যেমন— হেপাটাইটিস, ফ্যাটি লিভার কিংবা পারকিনসন’স-এর মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয়। এতে শরীরের অনেক প্রদাহ কমে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। ইঞ্জেকশন আকারে গ্লুটাথিয়ন নিলে ঘুমও ভাল হয়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি
কর্মক্ষেত্রে অত্যধিক চাপের কারণে, অল্প বয়সে বলিরেখা, পেশার খাতিরে প্রয়োজন হলে তবেই গ্লুটাথিয়ন থেরাপি করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন ডা. ধর। ব্যক্তি ও তাঁর সমস্যা অনুযায়ী ডোজ় ঠিক হয়। রোজ ৫০০ থেকে ১০০০ মিলিগ্রাম গ্লুটাথিয়ন নেওয়া যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ব্যবহার করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি নেই। তবে থেরাপির পরে সামান্য মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, র্যাশ, শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা হতে পারে। কিন্তু বেশি গ্লুটাথিয়ন নিলেই যে ত্বক আরও জেল্লাদার, সুন্দর হবে, এমনটা নয়। দীর্ঘকাল ধরে উচ্চ মাত্রায় গ্লুটাথিয়ন নিলে হার্ট, কিডনি, লিভার অচল হয়ে পড়তে পারে। এতে ওজন বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। গ্লুটাথিয়ন শরীরে জ়িঙ্কের মাত্রা কমায়। যার ফলে অ্যালার্জি, হাঁপানির মতো সমস্যা বাড়ে। তা ছাড়া, এতে ক্যানসারের কোষগুলিও অ্যাক্টিভ হয়ে উঠতে পারে। তাই নির্দিষ্ট সময় পরে গ্লুটাথিয়ন নেওয়া বন্ধ করা জরুরি।
- হার্টের সমস্যা বা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি যাঁদের রয়েছে, তাঁদের এই থেরাপি না করানোই ভাল।
- গর্ভবতী কিংবা ব্রেস্টফিডিং যাঁরা করান, তাঁরা এড়িয়ে চলুন।
- লিভার বা কিডনির সমস্যা থাকলে গ্লুটাথিয়ন নেবেন না।
খরচ কেমন?
রোদ থেকে আমাদের শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বেশি হয়। ডা. সন্দীপন ধর বলছেন, “এ কারণে ইঞ্জেকশন হোক বা ওষুধ, তা সূর্যাস্তের পরে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।” ওষুধ হিসেবে খেলে মাসে প্রায় দেড়-দু’হাজার টাকা খরচ। এক একটি ইঞ্জেকশনের দাম প্রায় তিন-চার হাজার টাকা। তবে টানা পাঁচ-ছ’মাসের বেশি গ্লুটাথিয়ন নেওয়া ঠিক নয়।
গ্লুটাথিয়নই কি একমাত্র উপায়?
গ্লুটাথিয়ন ছাড়াও ভিটামিন এ, সি, ডি, ই ইত্যাদি নিয়মিত নিলেও একই কাজ হয়। রেটিনল জাতীয় ক্রিম বা সেরামও একই কাজ করে। নিয়মিত যোগাভ্যাসে শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমে, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট বাড়ে। ডা. ধর বলছেন, “গ্লুটাথিয়ন কোনও ম্যাজিক নয়। কসমেটিক মার্কেট ও তারকাদের হাত ধরে হঠাৎ এ চিকিৎসার হাইপ তৈরি হয়েছে।”
ঘরোয়া উপায়
ওষুধ, ইঞ্জেকশনের ঝামেলা এড়িয়ে জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে বদল আনলেও শরীরে গ্লুটাথিয়ন বাড়ে। পুষ্টিবিদ কোয়েল পাল চৌধুরী বলছেন, “রোজকার খাবারে সালফার, ভিটামিন বেশি পরিমাণে রাখতে হবে। যে সকল খাবারে কারকিউমিন, পলিফেনল, সেলেনিয়াম বেশি থাকে তা-ও কার্যকর। এ ধরনের খাবার শরীরে গ্লুটাথিয়ন উৎপাদনে সাহায্য করে।” দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় রাখুন রসুন, ব্রকোলি, বাঁধাকপি, পালংশাক, ডিম, চিকেন, ডাল, বিনস ইত্যাদি। এগুলোয় সালফার থাকে। কমলালেবু, পাতিলেবুতে ভিটামিন সি, গ্রিন টি-তে পলিফেনল, মাশরুমে সেলেনিয়াম থাকে। কোয়েল বলছেন, “বয়স ধরে রাখতে রোজ চিয়া সিডস খাওয়া ভাল। ফ্ল্যাক সিড, পাম্পকিন সিডের মতো বিভিন্ন বীজ, কাজু, আমন্ডের মতো বাদামেও ভিটামিন ই-র ভরপুর জোগান থাকে।” এ ছাড়া, অ্যাভোকাডো, অ্যাসপারাগাস, জ়ুকিনি ইত্যাদিও শরীরে ন্যাচরাল গ্লুটাথিয়ন উৎপাদনে সাহায্য করে। ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না।
মরসুমি ফল, স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল আর ধূমপান, মদ্যপান বাদ দিলেই সুফল মিলতে পারে। তবে গ্লুটাথিয়ন থেরাপি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করাতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)