আত্মহত্যা নিয়ে যত আলোচনা হয়, ততটা হয় না প্রতিরোধ নিয়ে। ১০ সেপ্টেম্বর তারিখটি আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। যা পাঠ দেয়, একসঙ্গে বাঁচতে ও বাঁচাতে শেখার।
প্রতিদিন আমরা নিঃশব্দে হারাই বহু মানুষকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীতে এক জন মানুষ নিজেকে শেষ করে দেন। ভারতে প্রতি বছর প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন। এই সংখ্যাটা শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যা এক-একটি ভাঙা পরিবার, এক-একটি থেমে যাওয়া স্বপ্ন। আত্মহত্যা নিয়ে সমাজে যতটা কথা হয়, তার অর্ধেকও হয় না প্রতিরোধ নিয়ে। ১০ সেপ্টেম্বর তারিখটি আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। যা স্মরণ করিয়ে দেয়, আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব, আর সম্ভব একসঙ্গে বাঁচতে ও বাঁচাতে শেখা। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধের বার্তা যেন শুধু কাগজে-কলমে নয়, হৃদয় থেকেও উচ্চারিত হয়।
শ্রেয়া (নাম পরিবর্তিত) ১৯ বছরের এক ছাত্রী। গত বছর পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় বাড়ি ও সমাজের চাপ তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। শ্রেয়া ভেবেছিলেন, জীবন শেষ করাই সমাধান। কিন্তু এক বন্ধু তাঁর চোখে উদ্বেগের ছায়া দেখে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। শ্রেয়া আবার পড়াশোনায় ফিরেছেন।
অন্য দিকে, ৬৫ বছরের বিমলবাবু, যিনি অবসর নেওয়ার পর থেকে বাড়িতে অবহেলিত বোধ করতেন, প্রায়ই মনে করতেন, তাঁর বেঁচেথাকার অর্থ নেই। তিনি এক দিন প্রতিবেশীর সঙ্গে মন খুলে কথা বলেছিলেন, যিনি তাঁকে স্থানীয় সিনিয়র সিটিজ়েন ক্লাবে নিয়েযান। আজ বিমলবাবু সেখানে গান করেন, গল্প করেন, নতুন বন্ধু পেয়েছেন। আর পেয়েছেন বেঁচে থাকার নতুন মানে।
আবার মীরা (নাম পরিবর্তিত) এক কর্মজীবী নারী, সংসারের আর্থিক চাপে ও পারিবারিক ঝামেলায় ক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু অফিসের এক সহকর্মী তাঁকে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেন। এখন মীরা নতুন করে জীবনের আলো দেখছেন। এই তিনটি জীবনের বাস্তব গল্প আমাদের শেখায়— আত্মহত্যার চিন্তা মানেই শেষ নয়; সাহায্যের হাতথাকলে অন্ধকারেও আলো খুঁজে পাওয়া যায়।
আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা আছে, যিনি আত্মহত্যা করতে চান বা চেষ্টা করেছেন, তিনি মানসিক রোগী। এটি ভুল। মানসিক অসুস্থতা, যেমন ডিপ্রেশন, উদ্বেগ অথবা স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। কিন্তু এগুলিই একমাত্র কারণ নয়। আত্মহত্যার পিছনে রয়েছে নানা সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ। যেমন, শৈশবের নির্যাতন, পড়াশোনার বা প্রতিযোগিতার চাপ, বেকারত্ব, দাম্পত্য বা সম্পর্কে ভাঙন, আর্থিক ঋণের বোঝা, পারিবারিক কলহ, গ্রামে কৃষকদের সহজে কীটনাশক পাওয়া, ইত্যাদি। এ সবই এক জন মানুষকে চরম সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই যাঁরা বলেন ‘এ সব মানসিক রোগের ব্যাপার’, তাঁদের বোঝা দরকার, আত্মহত্যা সমাজের প্রতিচ্ছবি!
গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যার আগে অধিকাংশ মানুষ সাহায্যের সঙ্কেত দেন। আমরা তা ধরতে পারি না। আচমকা একাকিত্ব চাওয়া, বার বার মৃত্যুর কথা বলা,জীবনকে মূল্যহীন ভাবা, গভীর মানসিক অবসাদ, ঘুম-খিদের পরিবর্তন— এ সব ইঙ্গিত অবহেলা করবেন না। এগুলিকে বলা হয় ‘রেড ফ্ল্যাগ’, যা দেখলে আমাদের সতর্ক হতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে ‘গেটকিপার ট্রেনিং’ হল, যাতে আমরা প্রত্যেকে শিখতে পারি, কী ভাবে বিপদে থাকা কাউকে চিনব, শুনব, পাশে দাঁড়াব এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাব। এক জন সাধারণ মানুষও হতে পারেন জীবন রক্ষাকারী।
পড়ুয়াদের আত্মহত্যা সব চেয়ে বেদনাদায়ক। পরীক্ষার চাপ, প্রতিযোগিতা, সামাজিক প্রত্যাশা ও ব্যর্থতার ভয় অসংখ্য তাজা প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বওবড়। তারা যদি আত্মহত্যার ঘটনাকে নাম, ছবি, বিস্তারিত তথ্য দিয়ে ছড়ায় বা নাটকীয় ভাবে পরিবেশন করে, তবে তা অন্যদের জন্যও বিপজ্জনক বার্তা দিতে পারে। সংবেদনশীল রিপোর্টিংয়ের মানে হল— আমরা খবর দেব। কিন্তু মর্যাদা বজায় রেখে, বিকল্প পথের কথা বলে, বেঁচে থাকার উদাহরণ তুলে ধরে। আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে সমাজে সব সময়ে আলোচনায় আসে মৃত্যু। বেঁচে থাকার গল্প খুব কম প্রচার পায়। শ্রেয়া, বিমলবাবু বা মীরার মতো মানুষেরা আমাদের শেখান, আত্মহত্যার চিন্তা থেকে ফিরে আসা সম্ভব। তার জন্য দরকার মানুষের পাশে থাকা। আত্মহত্যা বা মৃত্যুভয় যেন সংবাদপত্রের শিরোনাম না হয়।
জীবন যতই কঠিন হোক, এক টুকরো সহানুভূতি, এক জন মনোযোগী শ্রোতা, একটি সাহায্যের হাত, এক মুহূর্তের পাশে থাকা— অসংখ্য জীবন বাঁচাতে পারে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ শুধু ডাক্তারের কাজ নয়, আমাদের সবার দায়িত্ব। আমরা যদি একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করি, শুনতে শিখি, বহু জীবন হারানোর আগে হাতে হাত রাখতে পারব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)