মা-বাবাদের রোজরুটিনের বেশির ভাগটাই সন্তানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। একটা সময়ের পরে যখন সেই সন্তান পড়াশোনা, চাকরি কিংবা বৈবাহিক সূত্রে অন্যত্র চলে যায়, বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যায়, মা-বাবার মধ্যে অনেক সময়েই তৈরি হয় শূন্যতার বোধ, একাকিত্ব। দিনের অনেকটা সময় যেন অযাচিত অবসর পাওয়া যায় হঠাৎ। এই পড়ে পাওয়া সময়টা কী ভাবে কাটাবেন তাঁরা, কী ভাবেই বা সন্তানের না থাকার অভাববোধ সামলে চলবেন, তা বুঝতে পারেন না অনেকে।
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ জানালেন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির পরিভাষায় একে বলে এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম। ব্যস্ত মা-বাবাকে হঠাৎ নতুন একটা রুটিনে নিজেদের অভ্যস্ত করতে হয়, বিশেষত মায়েদের। অনেকটা সময় চলে আসে হাতে, অথচ তেমন কিছু করার থাকে না। এই সময়ে মহিলাদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন আসে, ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমতে শুরু করে। বিশেষ করে বাড়িতে থাকা মায়েরা ভাবতে শুরু করেন, সব ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। পুরুষদের মধ্যেও একটা চাপা একাকিত্ব কাজ করে। বাড়িতে ফিরে একরাশ শূন্যতা গ্রাস করে যেন। সঙ্গীর সঙ্গে বলার মতো কথা ফুরিয়ে যায়।
তবে উপায়?
কোনও আসন্ন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করা উচিত আগে থেকেই। এ ক্ষেত্রে পায়েল ঘোষের পরামর্শ, বাচ্চারা যখন জুনিয়র থেকে সিনিয়র ক্লাসের দিকে যাচ্ছে, সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ওদের স্বাবলম্বী হতে দিন। পাশাপাশি নিজের জগৎ গড়ে তুলুন, যা কারও উপরে নির্ভরশীল নয়। “বয়ঃসন্ধির সময় থেকে সন্তানদের আচরণে পরিবর্তন আসে। তারা তখন অভিভাবকদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, ‘তোমাকে আমার আর ততটা দরকার নেই’। ওদের জীবনে বেশি ঢুকে না পড়া, নির্ভরতা কমানো শুরু করা দরকার তখন থেকেই। আর সেটাই স্বাভাবিক। বুঝতে হবে, সন্তানদের জগৎটা ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।”
আর ঠিক এই সময় থেকেই নিজেদের জন্য সময় বার করা, শখপূরণ কিংবা উপার্জন করার উপরে জোর দিতে হবে। যা যা এত দিন করে ওঠা হয়নি, সেগুলি শুরু করা যেতে পারে। শুধু শখপূরণ নয়, দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু সময় ব্যয় করা উচিত নিজেদের আর্থিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার দিকটিতেও। শেয়ার ট্রেডিংয়ের কোর্স, হাতের কাজ, ছোটখাটো ব্যবসা… বাড়িতে বসে কাজ করার এখন হাজারটা ব্যবস্থা রয়েছে। এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম এড়ানোর জন্য আগে থেকেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার উপায় খুঁজতে হবে। তা হলে সন্তানের অনুপস্থিতি উপলব্ধি করার আগেই নিজের রোজরুটিন একটা চেনা ছন্দে পড়ে যাবে।
নজর স্বাস্থ্যে
প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছনোর সময়ে শরীর তা জানান দিতে শুরু করে। এই সময়ে সন্তান বাইরে চলে গেলে নির্ভরশীলতা হারানোর আশঙ্কা কাজ করে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় বললেন, “শারীরিক সমস্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে আত্মবিশ্বাস কমতে শুরু করে। অ্যাংজ়াইটি তৈরি হয়, যা পরবর্তী কালে অবসাদের আকার নিতে পারে। ইদানীং প্রযুক্তির দৌলতে দূরে থেকেও সন্তান তার বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে পারেন। কিন্তু তাঁরা সবচেয়ে বেশি করে যেটা খোঁজেন, তা হল মানবিক সংযোগ।”
তাই সরাসরি কথোপকথন, নিরুৎসাহী মা-বাবাকে নতুন জিনিসে উৎসাহ দেওয়া, সময় পেলেই তাঁদের কাছে আসা, নাতি-নাতনিদের সাহচর্যের সুযোগ করে দেওয়া… এগুলোর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরলেন ডা. মুখোপাধ্যায়। জানালেন, তাঁর কাছে এমন অনেকেই আসেন, যাঁরা নিজেদের অবহেলিত বোধ করার ফলে স্থায়ী ভাবে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছেন। যাঁদের আগে থেকেই অ্যাংজ়াইটির প্রবণতা থাকে, তাঁরা দূরে থাকা সন্তানকে নিয়েও অকারণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হতাশা গ্রাস করছে বুঝলে পেশাদারের সাহায্য নিতে পারেন।
সঙ্গীর ভূমিকা
সন্তানের অনুপস্থিতির কারণে একাকিত্ব গ্রাস করলে সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন আপনার জীবনসঙ্গী। এই সময়ে পার্টনারশিপে সময় দিন। একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার আয়োজন, কফিশপে সময় কাটানো, সিনেমা দেখা… আগে যেগুলো সচরাচরকরা হয়ে উঠত না, সেগুলো ফের শুরু করুন। একা থাকলে শারীরচর্চা, শব্দছক-সুদোকু (এর মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার আবির্ভাবকেও হয়তো খানিক পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব), বাগান করা… নিজেকে ব্যস্ত রাখার, ভাল থাকার অনেক উপায় রয়েছে। কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েও কাজ করা যায়।
প্রকৃতির নিয়মে
প্রাণিজগতের নিয়মই হল, সন্তান স্বাবলম্বী হওয়ার পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া। বাইরে যাওয়ার জন্য সন্তানকে প্রস্তুত করার পরে তাকে নিজের নতুন জীবনে ছেড়ে দিন। মেন্টর হিসেবে অবশ্যই পাশে থাকুন, অভিজ্ঞতার দাম সব সময়েই রয়েছে। কিন্তু দূর থেকে সন্তানের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে যাবেন না। সন্তানকে প্রাধান্য দিন, কিন্তু সেটাই জীবনের সব নয়, তা উপলব্ধি করা দরকার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)