গত কয়েক সপ্তাহে আমার চেম্বারে বেশ কিছু নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে, যাঁরা কেউ জ্বর নিয়ে আসেননি। কিন্তু বলছেন, ‘সারা দিন একটা অজানা ক্লান্তি ঘিরে আছে’, ‘মনটা কেমন যেন ঝিমিয়ে থাকে’, বা ‘আগের মতো কোনও কিছুতেই মন বসাতে পারছি না’— এ সব কথা শুনলেই আমি প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, সম্প্রতি কি জ্বর বা সর্দি-কাশি হয়েছিল? অধিকাংশই মাথা নাড়েন, “হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, সপ্তাহখানেক আগে জ্বর এসেছিল, অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো।”
এই জ্বর এখন শুধু শহরে নয়, জেলাগুলিতেও দেখা যাচ্ছে। সাধারণত ৩–৫ দিন জ্বর থাকছে। মাঝে মাঝে ১০২-১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে। সঙ্গে গলা ব্যথা, দুর্বলতা, গায়ে ব্যথা। কিন্তু সমস্যা হল, জ্বর সেরে গেলেও শরীর আর মন ঠিক আগের মতো হতে চায় না। সব কিছু যেন ধোঁয়াটে, একটা মানসিক ঘোর ঘিরে থাকে। যেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না, আবার অনেকে গুরুত্বও দেন না।
কয়েক দিন আগেই এসেছিলেন ৩৮ বছরের সৌম্যদীপ, একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে কাজ করেন। জ্বর সেরে অফিসে ফিরেছেন, কিন্তু বলছেন, “ফাইল খুললে মনে হয় কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সহকর্মীদের বার বার জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে, ভুল করছি সহজ হিসেবেও।” যেটা ওঁর হচ্ছে, সেটা আমরা বলি ‘ব্রেন ফগ’। এর সঙ্গে থাকে খিটখিটে মেজাজ, ছোট ছোট কথায় অস্থিরতা, মন খারাপ, কাজে উৎসাহের অভাব। অন্য দিকে, পঞ্চান্ন বছরের বাসন্তীদেবী, যাঁর আগে থেকেই ডিমেনশিয়ার লক্ষণ ছিল, তিনি জ্বরের পরে এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন যে, মাঝরাতে বাড়ির লোকদের চিনতে পারছেন না। বার বার ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ছেলে বললেন, “মা আগে এতটা ভুল করতেন না।” তৃতীয় জন কলেজ পড়ুয়া সপ্তর্ষি, যাঁর আগে থেকেই পরীক্ষার সময়ে উদ্বেগ হত, জ্বরের পর থেকে বলছেন, “সব কিছু থেমে আছে মনে হচ্ছে। পড়তে বসি, মাথা ঝিমঝিম করে, ফোনে স্ক্রল করা ছাড়া কিছুই ভাল লাগে না।”
এঁদের সবার সমস্যা আলাদা হলেও মূল উপসর্গ একই— জ্বর সেরে গেলেও মন সেরে ওঠেনি।
এই ধরণের লক্ষণগুলিকে অনেক সময়ে শরীরের দুর্বলতা বলেই ধরে নিই। বাস্তব হল, ভাইরাস শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। কোভিড মহামারির পরে দেখেছি, দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ, অবসাদ, মনঃসংযোগের ঘাটতি, ঘুমের গোলমাল— এ সব নিয়ে কত মানুষ ভুগেছেন। তখন আমরা এই অবস্থার নাম দিয়েছিলাম লং কোভিড। এখনকার এই জ্বর বা ফ্লু থেকেও অনেকটা সে রকম মানসিক পরিণতি হচ্ছে, বিশেষত যাঁদের আগে থেকেই অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার বা অবসাদের মতো মানসিক অসুস্থতা ছিল।
বয়স্কদের সমস্যা আরও জটিল। তাঁদের স্মৃতিশক্তি, স্বাভাবিক আচরণ, এমনকি খাওয়া-দাওয়া বা ঘুমও এই ভাইরাসের পরে পাল্টে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, এই উপসর্গগুলি অনেক সময়ে চোখ এড়িয়ে যায় কিংবা ‘অলসতা’ বা ‘মনের দুর্বলতা’ বলে হালকা করে দেখা হয়।
কিন্তু বাস্তবে, উপসর্গগুলি যত তাড়াতাড়ি চিহ্নিত করা যায়, ততই ভাল। প্রথমেই দরকার পর্যাপ্ত বিশ্রাম, শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ, পুষ্টিকর খাবার, ঘুমের রুটিন ঠিক রাখা। যদি মানসিক অবসাদ, মনঃসংযোগে ঘাটতি, বিরক্তি বা অকারণে কান্না পাওয়ার মতো উপসর্গ কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকে, তা হলে মনোরোগ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। অনেকেই মনে করেন, ‘এই বয়সে কি মন খারাপ হয়?’, ‘এ সব ইচ্ছাশক্তির অভাব’। কিন্তু তা ঠিক নয়। কারণ মন এবং মস্তিষ্কও শরীরেরই অঙ্গ। তাদেরও ঠিক চিকিৎসা দরকার। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, যোগাসন, ফোন বা টিভির স্ক্রিন থেকে কিছুটা সময় দূরে থাকা, একা না থেকে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো অভ্যাস মনকে অনেকটাই স্থির করতে পারে।
সৌম্যদীপ, বাসন্তীদেবী ও সপ্তর্ষির পথ আলাদা হলেও গন্তব্য সুস্থ জীবন লাভ। ওঁদের কেউ ওষুধ নিয়েছেন, কেউ কাউন্সেলিং করেছেন, কেউ নিয়মিত জীবনযাত্রা বজায় রেখে ছন্দে ফেরা শুরু করেছেন। সৌম্যদীপ এখন ফের ব্যাঙ্কের ফাইল সামলাচ্ছেন। বাসন্তীদেবী রাতে ঘুমোচ্ছেন। আর ছেলে বলছেন, ‘‘মা অনেকটাই আগের মতো।’’ সপ্তর্ষিও পড়াশোনায় মন দিতে পারছেন। কারণ, শরীরের পাশাপাশি মনের যত্ন নিলেই সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। তাই ভাইরাল জ্বর হলে শরীরের যত্ন যেমন নিচ্ছেন, তেমনই মন ক্লান্ত লাগলে গুছিয়ে ভাবুন। প্রয়োজনে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ, মন ভাল থাকলে জীবনটা ফের গুছিয়ে নেওয়া যায়।
( মনোরোগ চিকিৎসক)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)