সিনেমা হলে, শপিং মলে, মেলায়... মাখনে ভরপুর পপকর্ন তৈরির গন্ধ জিভে জল আনে। তবে লোভনীয় সেই গন্ধই কিন্তু ডেকে আনতে পারে ‘পপকর্ন লাংস’-এর মতো মারণরোগও। সম্প্রতি আমেরিকার নেভাডার বাসিন্দা সতেরো বছরের চিয়ারলিডার ব্রায়ান কালেনের পপকর্ন লাংস ধরা পড়ার পর থেকেই ফের আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে এই সমস্যা। চিকিৎসকেরা বলছেন, মূলত একটু বয়সকালে দেখা দেয় এই রোগ। তবে ক্রমশ এর প্রকোপ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাড়ছে।
কী এই রোগ?
‘পপকর্ন লাংস’, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যা ‘ব্রঙ্কিয়োলাইটিস অবলিটেরানস’ মূলত ফুসফুসের সংক্রমণ। পালমোনোলজিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বলছেন, “এই ধরনের সমস্যাকে শনাক্ত করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে রাসায়নিক গ্যাসের সংস্পর্শে এসে ফুসফুসে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হয়। টার্মিনাল ও রেসপিরেটরি ব্রঙ্কিওলে (ছোট শ্বাসনালি) প্রদাহ হয়, যা থেকে সেখানে ক্ষত তৈরি হয়। এই ক্ষত রেসপিরেটরি ব্রঙ্কিওলকে ব্লক করে দেয়।” এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও অনেকটাই কম, তবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে অদূর ভবিষ্যতে সে সংখ্যা বাড়তে পারে বলে ধারণা চিকিৎসকদের।
কেন হয় এই সমস্যা?
এক সময়ে যাঁরা পপকর্ন কারখানায় কাজ করতেন, তাঁরা এই রোগে ভুগতেন। সেই সূত্রেই এই রোগের নামকরণ। পালমোনোলজিস্ট ডা. ধীমান গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “পপকর্ন তৈরির সময়ে মাখনের সুগন্ধ ও স্বাদ আনতে ডায়াসিটাইল নামক এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যা দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাসবায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করলে এই সংক্রমণ হতে পারে।” তবে পপকর্ন খেলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয় নেই, বলে জানাচ্ছেন ডা. অনির্বাণ। তাঁর কথায়, “এই রোগ কেবল দীর্ঘকাল বিষাক্ত বাতাস ইনহেল করলেই হয়।”
- ধূমপান ও দূষণ: অতিরিক্ত ধূমপান বা চেন স্মোকিংয়ের অভ্যেস যাঁদের থাকে, তাঁদেরও এই সমস্যা হতে পারে। তা ছাড়া, পরিবেশ দূষণের কারণে ক্রমশ বাতাসে বিষ মিশছে। ধুলো-ধোঁয়া বেশি রয়েছে, কারখানা এলাকা যেখানে দিনভর বিষাক্ত বাতাস নির্গত হয়, এমন জায়গায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ই-সিগারেট: সিগারেট ছাড়তে এখন অনেকেই ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (এন্ডস) বা ইলেক্ট্রনিক সিগারেট (ই-সিগারেট) ব্যবহার করেন। ফাইবার বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিচালিত যন্ত্রগুলির মধ্যে একটি প্রকোষ্ঠ থাকে। তার মধ্যে ভরা থাকে এক বিশেষ ধরনের তরল মিশ্রণ। যন্ত্রটি গরম হয়ে ওই তরলের বাষ্পীভবন ঘটায় এবং ব্যবহারকারী সেই বাষ্প টেনে নেন ফুসফুসে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘ভেপিং’। ডা. গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “এই বাষ্পেই মিশে থাকে অ্যাসিটালডিহাইড নামের এক ধরনের যৌগ, যা ফুসফুসের ক্ষতি করে। দীর্ঘ দিন এই অ্যাসিটালডিহাইড ভেপিং ফুসফুসে সিস্ট তৈরি করতে পারে। ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণের মধ্যে থাকে প্রপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, নানাবিধ ফ্লেভার এবং নিকোটিন, যা ফুসফুসের ক্যানসারের কারণও হয়ে উঠতে পারে।” চোদ্দো বছর বয়স থেকে ই-সিগারেটে নেশাসক্ত হয়ে পড়েছিল ব্রায়ানও। মঞ্চে অনুষ্ঠান করার আগে মানসিক চাপ কাটাতে নিয়মিত ই-সিগারেট ব্যবহার করত সে, যার ফলে অত্যধিক অ্যাসিটালডিহাইডে ক্ষতি হয়েছে তার ফুসফুসের।
- বিষাক্ত গ্যাস: ডায়াসিটাইল ছাড়াও অন্যান্য আরও কিছু ধাতব ধোঁয়া, ফর্মালডিহাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিন গ্যাস, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং সালফার ডাই অক্সাইডের মতো রাসায়নিক পদার্থও এই রোগের কারণ হতে পারে।
- সংক্রমণ: ক্রনিক নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিসের সমস্যা থেকেও পপকর্ন লাংস হতে পারে।
এ ছাড়া, ওয়েল্ডিংয়ের কাজ যাঁরা করেন, নিয়মিত অ্যাসিটালডিহাইডের সংস্পর্শে আসার কারণে তাঁরাও অনেক সময়ে এই রোগে আক্রান্ত হন। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও কিছু অটোইমিউন ডিজ়িজ়ের কারণেও এটি হতে পারে। ফুসফুস প্রতিস্থাপনের পরে পপকর্ন লাংস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে এ দেশে সে ঘটনা বিরল।
উপসর্গ কী?
দীর্ঘস্থায়ী শুকনো কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ ধরা এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গ। সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হতে পারে। ঘুমের সময়ে অত্যধিক ঘাম হওয়া, সাধারণ হাঁটাচলা করতে গেলে ক্লান্ত লাগার মতো সমস্যাও থাকে। রোগ বাড়লে বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি বাড়ে।
চিকিৎসার কথা
পপকর্ন লাংসের আলাদা কোনও চিকিৎসা নেই। এ ক্ষেত্রে মূলত উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার দেওয়া হয়। প্রয়োজনে চিকিৎসকেরা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে অ্যান্টিবায়োটিক, কাফ সিরাপ, অ্যান্টি-অ্যালার্জিকের প্রভাবে কিছু দিন চাপা পড়ে থাকলেও, ওষুধের মাধ্যমে এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হয় না। সাময়িক ভাবে তা কেবল নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডা. গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে পপকর্ন লাংসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।” প্রসঙ্গত ব্রায়ানও কিন্তু করোনা আক্রান্ত হয়েছিল।
এই রোগ সংক্রামক নয়। ধূমপান এবং ভেপিং দুই-ই ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। তাই নেশা ছাড়তে ই-সিগারেট নয়, ধূমপান বাদ দিতে হবে। কর্মসূত্রে রাসায়নিক বা বিষাক্ত গ্যাসের সংস্পর্শে যাঁরা নিয়মিত দীর্ঘ সময় কাটান, তাঁরা অবশ্যই মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করুন। সতর্ক থাকতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তবে শ্বাসকষ্ট, কাশি হওয়া মানেই কিন্তু পপকর্ন লাংস নয়। তা সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী সর্দি-কাশি বা ফুসফুসের ইনফেকশনকে অবহেলা করা ঠিক না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)