রোজ সকালে চায়ের সঙ্গে দুটো করে বিস্কিট খাওয়ার অভ্যেস অনেকেরই। ছোটদের জলখাবারে দুধ-বিস্কিট, টিফিনে ক্রিম বিস্কিটের প্যাকেট, বাড়িতে অতিথি এলে চা-কফির সঙ্গে এক প্লেট কুকিজ় দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে অনেকের। কিন্তু বিস্কিটের যে ক্ষতিকর দিকগুলো আছে, তা অনেক সময়েই আমরা ভেবে দেখি না। আসলে বিস্কিট আমাদের কাছে মুশকিল আসান গোছের একটা খাবার।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস জানালেন, আমাদের পাল্টে যাওয়া খাদ্যাভ্যাসই সমস্যার মূল কারণ। ‘‘শুধু বিস্কিট কেন, এই জাতীয় যে কোনও খাবার যে ভাবে উচ্চ তাপমাত্রায় তৈরি করা হয়, তা থেকে অ্যাক্রালামাইড তৈরি হয়। এটি কার্সিনোজেনিক, অর্থাৎ এর থেকে ক্যানসার হতে পারে। একই ক্ষতি হয় পাউরুটি বাদামি টোস্ট করে খেলে। গবেষণায় এই ধরনের খাবার নিয়মিত খাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি কুফল প্রমাণিত হয়েছে,’’ বললেন তিনি।
শুধু কার্সিনোজেনিক প্রভাব নয়, বিস্কিট তৈরির অন্যতম উপকরণ পাম অয়েল। ছোটদের যে ক্রিম বিস্কিট দেওয়া হয়, তা আরও ক্ষতিকর। এ ছাড়া বিস্কিট তৈরির প্রাথমিক উপাদান রিফাইনড সুগার, ময়দা ইত্যাদি কোনও উপকরণই শরীরের পক্ষে ভাল নয়। দীর্ঘ দিন ধরে নিয়মিত ভাবে ট্রান্স ফ্যাট শরীরে প্রবেশ করলে তা সমস্যা তৈরি করতে বাধ্য। একটা সময়ের পরে মধুমেহ, স্থূলতার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
বিস্কিট পুরোপুরি বর্জন করা কি সম্ভব? ডায়াটিশিয়ান হিনা নাফিস বললেন, ‘‘পুরো বাদ দেওয়াটা বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে না। এটি চট করে এনার্জি দেয়। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সৈনিকরা দ্রুত এনার্জি পাওয়ার জন্য বিস্কিট খেতেন। বিস্কিট অনেক দিন থাকে, জনপ্রিয়তার শুরুটা এখান থেকেই,’’ বললেন হিনা। পাশাপাশি মনে করিয়ে দিলেন, বিস্কিট রোজকার ডায়েটে আবশ্যক হতে পারে না। ‘‘আমরা বিস্কিট খাওয়া বন্ধ না করে বরং নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। অতিরিক্ত নোনতা বা মিষ্টি বিস্কিট এড়িয়ে চলাই ভাল,’’ মত হিনার।
অনেকে ডাইজেস্টিভ বা হাই-ফাইবার বিস্কিট খেয়ে থাকেন, ক্ষতি কম হবে ভেবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বিশ্বাস বললেন, ‘‘প্যাকেটে যা-ই লেখা থাকুক বিস্কিট তৈরির যে মূল উপকরণ ও প্রক্রিয়া, তাতে কোনও বিস্কিটই একশো শতাংশ স্বাস্থ্যকর হতে পারে না। বিদেশে বিশেষ এনজ়াইম ট্রিটমেন্ট করা হয়, যাতে ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ দেশে অত ব্যয়বহুল পদ্ধতি অবলম্বন করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। আর বিস্কিট তৈরিতে ব্যবহার হওয়া অ্যাডিটিভের কুপ্রভাব শরীরে পড়বেই।’’ সচেতনতা বাড়াতে প্যাকেটের গায়ে লেখা আইএনএস নম্বর ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখার পরামর্শ দিলেন অধ্যাপক বিশ্বাস। কী ধরনের অ্যাডিটিভ ব্যবহার করা হয়েছে, কোন মাত্রার প্রিজ়ারভেটিভ ও ফুড কালার আছে সেই সব তথ্য পাওয়া সম্ভব এই নম্বরটি থেকে।
স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসে ফেরায় জোর দিচ্ছেন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে প্রায় উঠে যেতে বসেছে চিঁড়ের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, ছাতু বা বেসনের লাড্ডু। এই বিকল্পগুলিতে অভ্যস্ত করতে পারেন বাচ্চাদের। কেক, পাউরুটির বদলে ফের জায়গা করে নিক চিঁড়ে, মুড়ি, সুজি। অধ্যাপক বিশ্বাস বলছেন, ‘‘এখন চল্লিশ পেরোতে না পেরোতেই যত ওষুধ খেতে হয়, আগে তা হত কি? ইমিউনিটি ব্যক্তিবিশেষে আলাদা। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত খাবারের কুফল অস্বীকার করা যায় না।’’ ডায়াটিশিয়ান হিনা নাফিস জোর দিচ্ছেন, কোনও খাবারকেই অভ্যেসে পরিণত না করতে।
দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে যাওয়া এই খাবার পুরো বর্জন করা হয়তো যাবে না। তবে বিস্কিট খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সেই পাঠ শুরু হোক ছোটবেলা থেকেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)