E-Paper

রাতজাগা তারাদের ঝুঁকি বেশি

কর্মক্ষেত্রে অনেকেই শিফটিং ডিউটি করেন। অনেককেই সারা রাত জেগে থাকতে হয় কাজের জন্য। এতে বায়োলজিক্যাল ক্লক পুরো বিপরীতে চলে। আদৌ কি তা স্বাস্থ্যকর? উপায় কী?

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৪৯

স্বাস্থ্য পরিষেবা, শাসন ব্যবস্থা, বিমান পরিষেবা-সহ বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত বহু কর্মচারী সারা বছর শিফটিং বা রোটেশনাল ডিউটি করে থাকেন। রস্টার অনুযায়ী কোনও দিন সকালে কাজ তো কোনও দিন নাইট ডিউটি। কাজের সময় পাল্টালেও বায়োক্লক কিন্তু সেই মতো উল্টো দিকে চলবে না। এতে সমস্যা বাড়ছে শরীরে, মনে। শিফটিং ডিউটি বা রাত জেগে কাজে আমাদের স্বাভাবিক স্লিপ-ওয়েক সাইকলটা ঘেঁটে যায়। ফলে নানা সমস্যা দেখা দেয়।

সমস্যার সূত্রপাত যেখানে

মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “প্রত্যেক জীবেরই একটা বায়োলজিক্যাল ক্লক থাকে। আমরা যখন ঘুমোই তখন কিছু হরমোন নিঃসরণ হয়। আবার যখন জেগে থাকি তখন কিছু হরমোন ক্ষরিত হয়। প্রত্যেকের বায়োলজিক্যাল ক্লকের বিশ্রামের সময়েও পার্থক্য আছে। আবার শরীরের প্রত্যেকটা কোষের রেস্টিং ফেজ় আলাদা। ফলে স্বাভাবিক স্লিপ-ওয়েক সাইকল মেনে না চললে তাঁদের এই শারীরবৃত্তীয় ঘড়ি বিঘ্নিত হয়। কারণ তাঁরা ঘুমোনোর সময়ে জেগে আছেন, খাচ্ছেন। যে সময়টা শরীরের কোষের বিশ্রাম পাওয়ার কথা, তখন তাকে কাজ করতে হচ্ছে।”

আবার অনেকে কর্মসূত্রে প্রায়ই দেশ-বিদেশে ট্রাভেল করেন। আজকে আমেরিকায়, তো দু’দিন পরে অস্ট্রেলিয়া। এঁদের আরও সমস্যা। কারণ এক দেশ থেকে অন্য দেশে গেলে টাইমজ়োন বদলে যাচ্ছে। হয়তো এক দেশে বারো ঘণ্টা দিনের বেলা কাটিয়ে অন্য দেশে গিয়ে সেখানেও বারো ঘণ্টা দিনের বেলা কাটালেন। এতে শরীরের মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়। আবার অনেকে রাত দুটো অবধি সিরিজ় দেখেন, ফোন ঘাঁটেন। এতেও স্লিপ সাইকল বিঘ্নিত হয়। ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “রাতে ফোন, ল্যাপটপ দেখলে কিন্তু ঘুম ভাল হয় না। ঘুমের জন্য অন্ধকার ঘর দরকার। অন্ধকারেই মেলাটোনিন হরমোন ক্ষরণ বেশি হয়। এই হরমোনের জন্যই আমাদের মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায়, আমরা ঘুমোই। রাতে যত ব্লু লাইট বা কৃত্রিম আলোর সামনে থাকবেন, তত মেলাটোনিন ক্ষরণ কমে যায়। ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।”

রোগবালাইয়ের আশঙ্কা

স্লিপ-ওয়েক সাইকল বিঘ্নিত হলে শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দেয়, যা অনেক রোগ ডেকে আনে। কিছু সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী আর কিছু সাময়িক। শর্ট টার্ম সমস্যার মধ্যে মুড সুয়িং, রাগ, হতাশা, অবসাদ আসতে দেখা যায়। হজমেও সমস্যা হয়। ভাল ঘুম না হলে বদহজম, অ্যাসিডিটির সমস্যা বাড়ে। ক্ষণস্থায়ী সমস্যার মধ্যে ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোমও রয়েছে। এর ফলে কগনিটিভ ফাংশন কমে যায়। সব সময়ে ঝিমুনি ভাব থাকে, কাজ করার সময়ে মনোযোগ থাকে না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও হ্রাস পায়, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এই জন্যই পরীক্ষার আগের রাতে পড়ুয়াদের ভাল ঘুম দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চাকুরিরতদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। এই প্রসঙ্গে ডা. তালুকদার বললেন, “জাপানে দেখেছি বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা লাঞ্চের পরে একটু ঘুমিয়ে নেন। একে বলে ন্যাপ টাইম। এতে মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে, কাজ আরও ভাল হয়।”

দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মধ্যে রয়েছে ডায়াবিটিস, ওবেসিটি, হৃদরোগ। রাত জাগার ফলে মেয়েদের সমস্যা আরও বেশি। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত যেমন বললেন, “দীর্ঘ কাল ধরে নাইট ডিউটি বা রোটেশনাল শিফটে কাজ করলে ব্রেনের মাস্টার বায়োক্লক প্রভাবিত হয়। এই বায়োলজিক্যাল ক্লক মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে অবস্থিত। আর এর সংলগ্ন পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে যে হরমোন নিঃসৃত হয় তা ওভারির কার্যক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয়ে যায়। এতে অনেকের গর্ভধারণে সমস্যা হয়। তবে সেটা নির্ভর করে মানুষটির বাকি জীবনযাপনের অভ্যাসের উপরে। তাই ডায়েট মেনে চলার ও রোজ পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরামর্শ দিই।”

উপায় কী?

ডা. তালুকদার বললেন, “এখন বেশির ভাগ ইন্ডাস্ট্রির কাজই রাত অবধি চলে, তাই নিজের একটা সাইকল ঠিকমতো বজায় রাখা খুব জরুরি। যাঁদের রোটেশনাল শিফটে কাজ, তাঁরা যে কোনও একটা শিফট টানা বেশ কয়েক দিন করার চেষ্টা করুন। এতে শরীর একটা রুটিনে থিতু হবে। ধরুন রাত দেড়টা-দুটোয় বাড়ি ফিরে ঘুমোচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে ন’টা অবধি ঘুমিয়ে নিন। ঘুমটা সম্পূর্ণ করুন। আর জল খেতে হবে বেশি করে।” অনেকেই রাতে বাইরে থাকলে জল কম খান। এতে বাকি সমস্যা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু শরীর হাইড্রেটেড রাখাটা খুব জরুরি। আর মনে রাখবেন, নাইট ডিউটি সেরে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি না ফেরাই ভাল। কারণ ঘুমের অভাবে মনঃসংযোগ কমে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে।

সুষম ডায়েট জরুরি

  • ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট প্রিয়াঙ্গী লাহিড়ী বলছেন, “রাত জেগে কাজ করলে শরীরের সার্কেডিয়ান রিদম বিঘ্নিত হয়। ঘুম, ক্ষুধা ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। বায়োক্লক ঠিক মতো কাজ না করলে হরমোন নিঃসরণও বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণের একটা সময় আছে। যেমন দিনের বেলা ইনসুলিন নিঃসরণ সবচেয়ে বেশি হয়। সে সময়ে উচ্চ ক্যালরির খাবার খেলে সমস্যা নেই। কিন্তু রাতে এই হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কমে যায়। তখন মেলাটোনিন ক্ষরণ হয় যা ঘুমের জন্য জরুরি আর তা ইনসুলিনের প্রভাব কমিয়ে দেয়। সে সময়ে যদি কেউ হাই ক্যালরি খাবার খায়, তার শরীর সেই রুটিন মেনে নিতে পারে না। আবার স্যাটাইটি হরমোন লেপটিন পেট ভরে যাওয়ার ও গ্রেলিন খিদে পাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। রাত জেগে কাজ করলে লেপটিনের মাত্রা কমে গ্রেলিনের মাত্রা বাড়ে। তাই রাত জেগে কাজ করলে খিদে পায়।”
  • রাতে খাবার খেলে হালকা খান। রোজ নির্দিষ্ট সময়ে ডিনার সেরে নিন। রাত একটার সময়ে বাড়ি ফিরে না খেয়ে আগে নির্দিষ্ট সময়ে ডিনার সারুন। দরকারে টিফিন সঙ্গে রাখুন।
  • অনেকে নাইট ডিউটি সেরে সকালে বাড়ি ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েন। এতে দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকলে অ্যাসিডিটির সম্ভাবনা থাকে। হালকা ব্রেকফাস্ট সেরে ঘুমোতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রিয়াঙ্গী।
  • রাত জেগে কাজ করতে হলে অনেকেই চা-কফির উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এই অভ্যাস বদলাতে হবে। সারা দিনে ৪০০ এমজি-র বেশি ক্যাফেইন ইনটেক করা যাবে না। কফি, চা, এনার্জি ড্রিঙ্ক সব মিলিয়ে এই মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গর্ভাবস্থায় আবার এই মাত্রা থাকবে ২০০-র মধ্যে। অনেকে রাত দুটো-তিনটের সময়ে বাড়ি ফিরে ঘুম না আসায় অ্যালকোহলের উপরে নির্ভর করেন। এটাও সমান ক্ষতিকর।
  • মাঝরাতে বাড়ি ফিরলেও সন্তানের স্কুলের জন্য সকালে উঠতে হয় অনেককে। ফলে রাতে ঘুম পুরো হয় না। পরে কিন্তু ঘুমিয়ে নিজের ঘুমটা পূরণ করে নিতে হবে। রোজ অন্তত সাত ঘণ্টা ঘুম দরকার।

শিফটিং ডিউটি করলেও বায়োক্লক অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন। অন্তত সময়মতো খান, পর্যাপ্ত ঘুমোন। এতে শরীর ভাল থাকবে, কাজের মানও বাড়বে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Night Shift Biological Clock

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy