রোগী শুয়ে রয়েছেন ইনদওরের হাসপাতালে। আর চিকিৎসকেরা বসে সেই সুদূর ফ্রান্সে। প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে দু’টি জটিল অস্ত্রোপচার করলেন চিকিৎসকেরা। দূরত্ব আর দূরত্বই রইল না। অসম্ভবকে সম্ভব করল রোবট। দেশের তৈরি সার্জিক্যাল রোবট ‘এসএসআই মন্ত্র’-কে কাজে লাগিয়ে অসাধ্যসাধন করলেন চিকিৎসকেরা।
রোবটিক অস্ত্রোপচার চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। তাই বলে বিদেশ থেকে এ দেশে অস্ত্রোপচার? তা-ও কি সম্ভব? এত দিন টেলিমেডিসিনের বিষয়টি নিয়ে জোর চর্চা চলছিল। রোগী যেখানেই থাকুন না কেন, ফোনে, অডিয়ো বা ভিডিয়ো কলে তাঁর সমস্যা শুনে ওষুধ বলে দেন চিকিৎসকেরা। রোগ জটিল হলে চিকিৎসাপদ্ধতিও বাতলে দেন। আর এখন তার থেকেও কয়েক কদম এগিয়ে টেলিসার্জারি চলে এসেছে এ দেশেও। রোগী দেশের যেখানেই থাকুন না কেন, রোবটিক সার্জারিতে চিকিৎসকেরা পৃথিবীর যে কোনও দেশে বসেই অস্ত্রোপচার করতে পারবেন। রোবটের যান্ত্রিক হাত বহু দূর থেকেও চালনা করা সম্ভব।
সম্প্রতি ইনদওরের অরবিন্দ ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স এবং আইআরসিএডি ন্যাশনাল সেন্টারে দু’টি জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে রোবটিক টেলিসার্জারিতে। একটি ‘গ্যাস্ট্রিক বাইপাস’ অর্থাৎ, ওজন কমানোর অস্ত্রোপচার, অন্যটি ‘কার্ডিয়াক অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট’ (এএসডি) অর্থাৎ, হার্টের এক জটিল রোগের অস্ত্রোপচার। ফ্রান্সে বসে চিকিৎসকেরা রোবট চালনা করেন, অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় নির্দেশও দেন। তাঁদের সহযোগিতায় এখানকার চিকিৎসকেরা নির্ভুল ভাবে অস্ত্রোপচার করেন। দেশের আইআরসিএডি-র প্রেসিডেন্ট মোহিত ভন্ডারী জানিয়েছেন, রোবটের সাহায্যে গ্যাস্ট্রিক বাইপাসের সার্জারি করতে সময় লেগেছে মাত্র ৪৪ মিনিট। অস্ত্রোপচারের সময়ে বিন্দুমাত্র জটিলতা আসেনি।
রোবটিক সার্জারি আসলে কী?
হাত-পা নেড়ে চলা কোনও রোবট কিন্তু আসলে অস্ত্রোপচার করে না। করেন চিকিৎসকেরাই। রোবটিক সার্জারি বলে ইন্টারনেটে খুঁজলে ছবিতে যে লম্বা লম্বা হাতবিশিষ্ট যন্ত্রটি দেখা যায়, সেটিই হল রোবট। তার হাতগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে রোগীর শরীরে অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসক নিজেই। অর্থাৎ, বিভিন্ন অস্ত্রোপচারে যেমন নানা ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, এ ক্ষেত্রে সেই যন্ত্রটি হল একটি রোবট।
আরও পড়ুন:
এই যন্ত্রের একটি ‘চোখ’ আছে, যা দিয়ে থ্রি-ডি বা রোগীর শরীরের ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শিরা-উপশিরার খুব স্পষ্ট ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যায়। যন্ত্রের চোখ দিয়ে দেখলে চিকিৎসক রোগীর শরীরের ভিতরের অংশগুলি প্রায় ৪০ গুণ বেশি বড় করে দেখতে পারেন। ওই যন্ত্রের মাধ্যমে দেহে ক্ষুদ্র কয়েকটি ফুটো করে অস্ত্রোপচারের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যায় টেলিস্কোপিক ক্যামেরা। সঙ্গে ক্যামেরা, ছুরি, কাঁচি, সুচের মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। সার্জারির জায়গার কাটা-ছেঁড়া, সেলাই, সবই হয় রোবটের হাত দিয়ে। রোবটিক সার্জারি ব্যাপারটি অনেকটা ভিডিয়ো গেমের মতো। দূর থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে রোবটটিকে চালনা করেন চিকিৎসক নিজেই।
ইউরোলজি, শল্য, হৃদ্রোগ, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি, স্ত্রীরোগ, কিডনি এবং হেড অ্যান্ড নেক, স্তন, কোলন-ক্যানসারের জটিল অস্ত্রোপচারে রোবটিক সার্জারির প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বাড়ছে। রোবটিক সার্জারিকে মানুষের আরও কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ২০১৯ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক রোবট প্রস্তুত করে গুরুগ্রামের সংস্থা ‘এসএস ইনোভেশন’। তাদের তৈরি প্রথম দেশীয় রোবট ‘এসএসআই মন্ত্র’ ২০২২ থেকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। আরও উন্নত প্রযুক্তিকে সংযুক্ত করে ওই রোবটের তৃতীয় সংস্করণও চলে এসেছে।