E-Paper

ভুল খাদ্যাভ্যাসে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ছে বাচ্চাদের

ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল বাচ্চাদের মধ্যে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে হৃদ্‌রোগের। জরুরি খাদ্যাভাসে বদল

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:০৬

এখন বাচ্চাদের খাদ্যাভ্যাসে নজর রাখলেই দেখা যায় জাঙ্ক ফুডের রমরমা। পিৎজ়া, পাস্তা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফ্রায়েড চিকেন... প্রত্যেকটি খাবারই ট্রাইগ্লিসারাইডের গুদামঘর বলা যায়। তার উপরে বেশির ভাগ বাচ্চার খেলার অভ্যাস নেই বললেই চলে। অধিকাংশই বাড়িবন্দি। ১২-১৩ বছর বয়সিরা ফুড ডেলিভারি অ্যাপে নিজেদের খাবারও আনিয়ে নিতে পারে। ফলে বাড়িতে বসে এক দিকে জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। অন্য দিকে, শারীরিক কসরতও হচ্ছে না। অতএব, আর্টারিতে ট্রাইগ্লিসারাইড জমা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।

ভাজাভুজি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে কোলেস্টেরলের মাত্রাও বাড়তে থাকে। তবে কোলেস্টেরলের ভাগটা বুঝতে হবে এখানে। এইচডিএল হল হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, এটা ভাল কোলেস্টেরল নামেই পরিচিত। এইচডিএল শিরা, ধমনীর মধ্য থেকে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল সংগ্রহ করে লিভারে পৌঁছে দেয়। লিভার সেটা শরীর থেকে বার করে দেয় বা রিসাইকল করে। আর লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এলডিএল হল খারাপ কোলেস্টেরল। এলডিএল লিভার থেকে বিভিন্ন শিরা-ধমনিতে কোলেস্টেরল পৌঁছে দেয়। এ বার রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড, এলডিএল-এর মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে আর এইচডিএল-এর মাত্রা কমে গেলে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী বলছেন, “নেফ্রোটিক সিনড্রোম থাকলেও কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হয়। তবে নেফ্রোটিক সিনড্রোমের চিকিৎসা করলে তার মাত্রা কমে যায়। আর জেনেটিক কারণেও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি থাকে অনেকের। এর থেকে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হতে পারে। আর্টারিতে ফ্যাট, কোলেস্টেরল জাতীয় পদার্থ জমা হলে এই সম্ভাবনা তৈরি হয়। এতে আর্টারি ব্লক হয়ে যেতে পারে। তখন স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। আর জীবনযাপনে, খাদ্যাভ্যাসে বদল আনার পরামর্শ দেওয়া হয়। আমরা বলি পুফা জাতীয় তেল খেতে। পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্য়াসিড সমৃদ্ধ তেল খেলে এই ধরনের সমস্যা অনেকটাই এড়ানো যাবে।”

খাদ্যাভ্যাসে বদল জরুরি

ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট প্রিয়াঙ্গী লাহিড়ি বলছেন, “মাংসের চর্বি, রেড মিট, সসেজ, সালামিতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে। এ ছাড়াও চিজ়, আইসক্রিম, চকলেট, প্যাকেজড ফুড অর্থাৎ চিপস জাতীয় খাবারেও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা বেশি। বাচ্চারা এই ধরনের খাবার খেতেই ভালবাসে। কিন্তু বড়দের খেয়াল রাখতে হবে, এই ধরনের খাবার যেন সে নিয়মিত না খায়। বাচ্চার ওজন বেশি হলে, এ সব খাবারে রাশ টানতে হবে।”

ট্রান্স-ফ্যাটের মাত্রা বেশি হলেও ক্ষতি। কেক, বিস্কিট ইত্যাদি খাবারে ট্রান্স-ফ্যাট বেশি থাকে। বিশেষত হ্যান্ডমেড বেকারির খাবারে এর মাত্রা বেশি থাকে। যে কোনও স্ট্রিট ফুড, যা এক তেলে বারবার ভাজা হচ্ছে, সেই খাবারেও ট্রান্স-ফ্যাটের মাত্রা বেশি থাকে। তাই এগুলো বাদ দিতে হবে।

প্রিয়াঙ্গী বললেন, “ট্রাইগ্লিসারাইডের ব্যাপারেও সচেতনতা দরকার। আমরা তেল বা বিভিন্ন ফ্যাটজাতীয় যে খাবার খাচ্ছি, এগুলো ট্রাইগ্লিসারাইডের উৎস তো বটেই। এ ছাড়াও আমরা যে কার্বস খাচ্ছি, তার পরিমাণ যদি অতিরিক্ত হয়, তা হলে সেটা লিভারে ট্রাইগ্লিসারাইডে পরিণত হয় ও রক্তে তার মাত্রা বাড়ে। বিশেষত রিফাইনড কার্বস থাকলে অর্থাৎ ময়দা, চিনির পরিমাণ বেশি থাকলে ট্রাইগ্লিসারাইড তৈরি হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।”

কী কী করবেন?

  • বাচ্চাদের মধ্যে খেলাধুলোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাচ্চা ওবিস হলে নিয়মিত সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানোর মতো অভ্যাস তৈরি করতে হবে। বাড়িতে সারা দিন যেন বাচ্চা বসে না থাকে।
  • কার্বস বাছার সময়ে সচেতন থাকতে হবে। ময়দার বদলে আটার খাবার দিন, রিফাইনড চালের বদলে ঢেঁকি ছাটা চাল খেলে ভাল। আলুর পরিমাণ কমিয়ে সবুজ আনাজপাতির পরিমাণ বাড়াতে হবে খাদ্যতালিকায়। জরুরি হল ফল খাওয়া। আপেল, পেয়ারা, শসা, মুসাম্বি, কমলালেবু জাতীয় ফল দিন। মিষ্টি ফলও দিতে পারেন, তবে মাপমতো।
  • অনেক বাচ্চা ইনস্ট্যান্ট নুডলস বা রাস্তার ধারের চাউমিন, রোল খেতে পছন্দ করে। এগুলোই বাড়িতে একটু স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে বানিয়ে দেওয়া যায়। আটা বা রাগি নুডলস বেছে নিতে পারেন। তবে স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প বেছে নিলেই হবে না, তার মধ্যে পরিমাণ মতো গাজর, বিনস ইত্যাদি আনাজপাতি, প্রোটিনও রাখতে হবে। রোল বাড়িতেও তৈরি করা যায়। ময়দা ব্যবহার না করে সে ক্ষেত্রে আটার রোল বানিয়ে দিতে পারেন।
  • ফ্যাট কমাতে হবে বলে বাদাম খাওয়া বন্ধ করবেন না। মনে রাখবেন বাদাম ভাল স্নেহপদার্থ। আমন্ড, পিনাট দিতে পারেন। জলে ভিজিয়ে এই জাতীয় বাদাম খাওয়াই ভাল। তবে সেটাও একটা নির্দিষ্টি মাপে।
  • বাড়িতে হাতে গড়া আটার রুটি-সবজি, সুজি, অঙ্কুরিত ছোলার স্যালাড, ভাত-ডাল, মাছের ঝোল খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করুন। তবে বাড়ির খাবার বলে বেশি খাওয়াবেন না।
  • অনেকেই কোলেস্টেরল বা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে ছোটদের ডিম বন্ধ করে দেন। কিন্তু বাচ্চারা রোজ একটি করে ডিম খেতে পারে। এতে সে পুষ্টি পাবে। বরং মেয়োনিজ়, বিভিন্ন ডিপ, সস খাওয়া বন্ধ করুন। বিকল্প বেছে নিন। মেয়োনিজ়ের বদলে হার্বস দিয়ে হাং কার্ড ব্যবহার করুন। সসের বদলে টম্যাটো পিউরি করে একটু রসুন বাটা দিয়ে সসের মতো ব্যবহার করুন।
  • দোকানের মিল্ক শেক, চকলেট শেক না দিয়ে বাড়িতে কলা, দুধ, দিয়ে স্মুদি বানিয়ে দিন।

খেয়াল রাখবেন, বাচ্চার ডায়েট যেন ব্যালান্সড হয়। ছোটদের মস্তিষ্কের গঠনের জন্য যে খাবারগুলি প্রয়োজন, তাতে যেন টান না পড়ে। তাই পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে ডায়েট চার্ট বানিয়ে নিন। বছরে একটা রুটিন হেলথ চেকআপও জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Unhealthy Food Heart Attack

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy