মোয়া প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ীরা ৫ অঘ্রাণ তারিখকে মোয়া বানানোর প্রথমদিন হিসেবে মাণ্যতা দিয়ে কাজ শুরু করেন। আবার অনেকে রাস পূর্ণিমার দিনকে শুভদিন ধরে কাজ শুরু করেন। খুব শীত না পড়লে মোয়া পাওয়া যাবে না। শীতেই পাওয়া যাবে নলেন গুড় আর কনকচূড় খই। জয়নগর, বহড়ু, মদিলপুর, নিমপীঠ এলাকার মোয়া ব্যবসায়ী তাঁদের প্রথম তৈরি মোয়াটি নিবেদন করেন এই অ়ঞ্চলের প্রণম্য দেবতা ধন্বন্তরী মাতা, জয়চণ্ডী মাতা ও রাধাবল্লভকে। তার পর টানা তিন মাস মত চলে মোয়ার ব্যবসা।
তবে এ কথাও সত্যি কৌলীন্য হারাচ্ছে জয়নগরের মোয়া। শীত পড়তে না পড়তেই গোটা কলকাতা ও শহরতলি জুড়ে যে মোয়ার ছড়াছড়ি সেগুলোকে জয়নগরের মানুষরা বলেন, ‘কেড়ো মোয়া’। আসল মোয়া কিন্তু বাজারে আসতে সময় লাগবে অনেক। শিউলি সম্প্রদায়ের হাতে তৈরি খেজুর গাছের জিরেন কাঠের রস থেকে নলেন গুড় তৈরি হয়ে সেটি কনকচূড় ধানের খইয়ের সঙ্গে রসায়ন তৈরি হচ্ছে না হচ্ছে, ততদিনে জয়নগরের মোয়ার মূল স্বাদ পাওয়া যাবে না। মোয়া তৈরিতে যে সমস্ত মূল কাঁচামাল লাগে, সেগুলির পরিবর্তে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জয়নগরের মোয়ার নাম দিয়ে যা খুশি বানাচ্ছেন। এরা চিনির গাদ, এসেন্স, চায়ের লিকার, মরিশাল ধানের খই ও সামান্য গুড় ছিটিয়ে মোয়া তৈরি করেন। এই মোয়া খুবই শুকনো। সেখানে জয়নগরের মোয়া খুব নরম ও মুখে দিলে গলে যাবে। আরও একটা ব্যাপার জয়মোয়াতে ক্ষীর জাতীয় কিছু থাকে না। সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য কেড়ো মোয়ায় সাদা রঙের ক্ষীর ময়দার গুড়ো ছেটানো হয়।
জয়নগরের মোয়া নিয়ে অনেক গল্প হল। ইতিমধ্যে সামনেই আসছে পৌষসংক্রান্তি। প্রতি উৎসব পালনেরই নিজস্ব প্রথা আছে। পৌষ সংক্রান্তি মানেই পিঠেপুলি। বাঙালির পৌষসংক্রান্তির আয়োজনে নারকেল কোরা আর টাটকা খেজুর গুড়ের অনবদ্য রসায়নে পিঠের মৌতাত। শীত মানেই পিঠে পার্বণের মাস। বাঙালির গৃহস্থালিতে পিঠে তৈরির প্রস্তুতিও চলে জোরদার। নতুন ধানের চালের গুঁড়ো, ঘড়াভর্তি খেজুর গুড়ের মায়াবি তরল পাটালি—পৌশপার্বণ মানেই নবান্নের আহ্বান। সুগন্ধি আতপ চালের সঙ্গে খেজুর গুড়ের অকৃত্রিম চেনা কৌলিন্য। কত বাহারি নাম—গোকূল পিঠে, পাটিসাপটা, সিদ্ধ পুলি, রাঙা আলুর পুলি, ছানার পুলি, চুষি পিঠে, দুধ পুলি, রসবড়া, চৈতি পিঠে, ভাপা পিঠে, মুগডালের পিঠে, নারকেল পুলি পিঠে, নলেন গুড়ের পায়েস, মালপোয়া। বাঙালির রসনাকে প্রলুব্ধ করতে কত বৈচিত্র কত আয়োজন। খেয়েও তৃপ্তি, খাওয়াতেও।
আবার এ পার বাংলায় যেটি ‘পিঠে’ সেটি ওপার বাংলায় বলা হয় ‘পিঠা’। শীতের দোসর আমাদের কাছে ‘পিঠে’ মানেই মিষ্টি জাতীয় মুখরোচক পদ। কেজুর রস বা চিনির রস-দুধ-নারকেল কোরা দিয়ে প্রস্তুতি মিষ্টান্ন। অথচ ওপার বাংলায় নাকি মিষ্টি স্বাদ ছাড়াও কিছু পিঠে প্রস্তুত করা হয় নোনতা বা ঝাল জাতীয়। যেমন বরিশালের জনপ্রিয় পাকন পিঠা কিংবা মুগ পাকন পিঠা। এ ছাড়াও বাঙাল বাড়িতে কলার পিঠা, গোপাল পিঠা, ভাপা পিঠা, বিবিখানা পিঠা, নকশি পিঠা, আমকে পিঠা, চিঁড়ের পিঠা, খাঁজের পিঠা, ছিটা পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের পান্তুয়া পিঠা ইত্যাদি হরেকরকম পিঠা প্রস্তুত হয়। ওখানে উল্লেখযোগ্য শুধুমাত্র নিরামিশ নয়—ডিম, শুঁটকি মাছ, অনান্য মাছ ও মাংস ও ওপার বাংলার পিঠা প্রস্তুতিতে দিব্যি ব্যবহার হয়।
কিছু সনাতনী পিঠের রেসিপি মুম্বই ক্রোড়পত্রের পাঠকবৃন্দের জন্য শেয়ার করা যাক:
সেদ্ধ পুলি
উপকরণ: ২ কাপ চাল গুঁড়ো, দেড় কাপ তাজা নারকেল কোরা, গরম জল সেদ্ধ করার জন্য, এক কাপ গুড়, সামান্য নুন।
পদ্ধতি: অনেকটা ইডলির মতো প্রস্তুতি। ময়দা নারকেল গুড় এক সঙ্গে মেখে হাতের তালুতে চ্যাপ্টা আকার দিয়ে ইডলি পাবে সাজিয়ে গরমজল-সহ আঁচে ভাল করে ফোটাতে হবে। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে দেখে নিতে হবে সেদ্ধ হয়েছে কিনা। যখন নরম অথচ হাতে বা চামচে লেগে যাবে না, তার মানে সেদ্ধ পুলি তৈরি। ঝোলাগুড়ের সঙ্গে অনবদ্য।
চিঁড়ের পিঠে
উপকরণ: ২ কাপ চিঁড়ে, ১ কাপ কোরা, দু’কাপ গুড়, ১ কাপ ময়দা, ভাজার ঘি।
পদ্ধতি: নারকেলের সঙ্গে গুড় মেখে ননস্টিক প্যানে মাখামাখা করে নিতে হবে। অন্য পাশে চিনি বা গুড়ের সিরাপ করে ঠান্ডা করে রাখতে হবে। এ বার চিঁড়ে গরম জলে ধুয়ে জল ঝরিয়ে মেখে নিতে হবে ঠেসে ঠেসে। মাখা মণ্ড থেকে একটা গোলা নিয়ে ভেতরে নারকেলের পুর দিয়ে গড়ে রাখতে হবে। এ বার ওই পুরভরা চিঁড়ের পিঠে ছাঁকা ঘি-তে লাল করে ভেজে চিনির রসে ফেলতে হবে। কিছু সময় রেখে পরিবেশন করতে হবে।
সরু চাকলি
উপকরণ: ১/২ কাপ চাল, আদা রস, ১ কাপ কলাইডাল, সামান্য মরিচ গুঁড়ো, পরিমাণ মতো নুন, ভাজার জন্য সাদা তেল।
পদ্ধতি: চাল ও ডাল আলাদা পাত্রে ২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। জল ছেঁকে এক সঙ্গে মিক্সিতে বেটে ঢাকা দিয়ে আরও ২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এর পর ওই মিশ্রণে আদার রস, নুন, মরিচ গুঁড়ো, এক চিমটে খাবার সোজা দিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে আরও আধঘণ্টা রেখে দিতে হবে। ননস্টিক প্যানে সাদা তেল ছিটিয়ে একে একে ধোসার মত গোল করে এপিঠ ওপিঠ ভেজে তুলে রাখতে হবে। ঝোলা গুড়ের সঙ্গে জুবিয়ে সরু চাকলি—আহা!