Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Covid -19

মানবদেহেই ‘কোভিড-কবচ’, খোঁজ ভারতীয় গবেষণাগারে

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এক সময়ে পোলিয়ো সংক্রমণের ভয়াবহতা দেখেছে বিশ্ব। গুটিবসন্তও দেখেছে। কিন্তু নিয়মিত টিকাকরণে দু’টি রোগই প্রায় নিশ্চিহ্ন।

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল কুমার এবং প্রবাল বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁ দিক থেকে ডান দিকে)।

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল কুমার এবং প্রবাল বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁ দিক থেকে ডান দিকে)।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৩ ০৮:৫৬
Share: Save:

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বহু দিন আগে জানিয়ে দিয়েছে, সার্স-কোভ-২ কোনও দিনই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হবে না। ঠিক যে-ভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস রয়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় কোভিড-১৯-কে প্রতিহত করতে একটি নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থার সন্ধান দিলেন এ দেশের এক দল গবেষক। বিজ্ঞানের ভাষায় ‘হোস্ট ডিরেক্টেড থেরাপি’। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘প্লস প্যাথোজেনস’ নামক জার্নালে।

এই গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ বা আইআইএসইআর (মোহালি)-এর বিজ্ঞানীরা। তাঁদের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে কাজ করেছে আইআইটি রোপার, আইআইএসসি বেঙ্গালুরু, সিএসআইআর-ইমটেক। গবেষক দলের প্রধান, আইআইএসইআর-এর ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আইআইটি-র প্রবাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এক সময়ে পোলিয়ো সংক্রমণের ভয়াবহতা দেখেছে বিশ্ব। গুটিবসন্তও দেখেছে। কিন্তু নিয়মিত টিকাকরণে দু’টি রোগই প্রায় নিশ্চিহ্ন। কোভিডের ক্ষেত্রে এমন কোনও সম্ভাবনা এখনই দেখছেন না বিশেষজ্ঞেরা। তার কারণ সার্স-কোভ-২ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা, এই দু’টো ভাইরাসই অনেক দ্রুত মিউটেট করে বা ভোল বদলায়। ফলে একে নিয়ন্ত্রণে আনা বা নির্মুল করা খুবই কঠিন। তাই ভাইরাসকে অকেজো করার বদলে নতুন গবেষণায় জোর দেওয়া হয়েছে মানবদেহের কোষের কিছু সুড়ঙ্গপথে, যেগুলোর মাধ্যমে ভাইরাস চুপিসারে কোষে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়।

ইন্দ্রনীল জানিয়েছেন, কোভিড প্রতিরোধে যে-সব ওষুধ বাজারে উপস্থিত রয়েছে, সবই ভাইরাসকে নিশানা করে। এরা হল ‘ডিরেক্ট-অ্যাক্টিং অ্যান্টিভাইরাল’। এরা ভাইরাসকে নিশানা করে বলে, ভাইরাস যেই মুহূর্তে মিউটেশন করে রূপ বদলায়, চলতি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধগুলি অনেক ক্ষেত্রেই আর প্রত্যাশিত ভাবে কাজ করে না। ঠিক এই কারণে, ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা প্রতি বছর ‘আপডেট’ করতে হয়। কারণ ভাইরাসটি দ্রুত রূপ বদলায়, টিকাও পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু তার পরেও ভাইরাসের মিউটেশনের জেরে প্রতি বছর গোটা বিশ্বে লক্ষাধিক মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যান।

আইআইএসইআর-এর গবেষণায় মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন গবেষক-ছাত্র নির্মল কুমার। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিতে তাঁরা ভাইরাসকে নিশানা না-করে মানুষের শরীরেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টা এমন: যদি ঘরের দরজা বন্ধ রাখা যায়, সে-ক্ষেত্রে শত্রু কোনও ভাবেই শরীরে ঢুকতে পারবে না। সেই শত্রু যতই চেহারা বদলাক।

ইন্দ্রনীল জানিয়েছেন, অতিমারি শুরুর আগে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তখন লক্ষ্য ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা। কিন্ত পরে তাঁরা দেখেন, এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সার্স-কোভ-২, দু’টি ভাইরাসকেই প্রতিহত করা সম্ভব। আইআইটি-র বিজ্ঞানী প্রবাল তাঁদের ল্যাবে তৈরি কিছু নতুন যৌগ ইন্দ্রনীলদের দিয়েছিলেন, সেগুলোর ভাইরাস-প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। এর মধ্যে আকস্মিক ভাবেই ডাই-ফিনাইল ইউরিয়া ডেরিভেটিভস (ডিপিইউডি) দারুণ ভাবে কাজ করে যায়। প্রবাল বলেন, ‘‘আমরা অন্তত ৪০টি ডেরিভেটিভ নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছিলাম। দেখা যায় ৫টি ডিপিইউডি (ডিপিইউডি-১, -২, -১৬, -২০ ও -২৩) দারুণ কাজ দিচ্ছে।’’ ইন্দ্রনীল জানিয়েছেন, তাঁরা গবেষণাগারে দেখেন, এই যৌগগুলি মানুষের শরীরের হোস্ট সেল বা যে কোষে ভাইরাস প্রবেশ করে, তাকে নিশানা করছে। মানবকোষের যে-সুড়ঙ্গপথ দিয়ে ভাইরাস প্রবেশ করে, সেই রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে।

ইন্দ্রনীল জানিয়েছেন, তাঁদের সন্ধান পাওয়া যৌগগুলি টিকা নয়, ওষুধ হিসেবে কাজ করবে। ফলে কোনও রোগীর সংক্রমণ ঘটলে তখন এটির ব্যবহার। তাঁরা এ-ও জানিয়েছেন, কোনও রোগীকে এই ওষুধ দেওয়া হলে, তা ভাইরাসকে শরীরের এক কোষ থেকে অন্য কোষে ছড়িয়ে পড়তে দেবে না। দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করবে। ক্রমে কাবু করবে রোগকে। গবেষণাগারে অ্যানিম্যাল ট্রায়াল বা প্রাণিদেহে পরীক্ষা সফল হয়েছে। তাতে এর কার্যক্ষমতা ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ প্রমাণিত হয়েছে। যে-হেতু ওষুধ প্রয়োগে মানবকোষের পরিবর্তন, তা-ই বিষক্রিয়ার আশঙ্কাও খতিয়ে দেখা হয়েছে। ইন্দ্রনীল ও প্রবাল, দু’জনেরই দাবি, ‘‘সাইটোটক্সিসিটি একেবারেই নেই। ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় নেই। পরীক্ষাগারে প্রাণিদেহে এর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।’’

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই ৫টি ডিপিইউডি সার্স-কোভ-২-এর প্রায় সব স্ট্রেনকে রুখতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। উহান স্ট্রেন, ডেল্টা স্ট্রেন, ওমিক্রন— সবেতেই কাজ দিয়েছে এটি। ভাইরাস যে রূপেই আসুক, ওষুধ প্রয়োগে মানবকোষে যে বদল ঘটবে, তাতে এটি সংক্রমণ ঘটাতে পারবে না। বিজ্ঞানীদের দাবি, বাজারে যে হাতেগোনা কয়েকটি কোভিডের ওষুধ রয়েছে, তার থকে বহু গুণ কার্যক্ষমতা তাঁদের সন্ধান পাওয়া যৌগগুলির। আবার একই ভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জার এইচ১এন১ এবং এইচ৩এন২ স্ট্রেনকেও রুখে দিতে পারে এই ‘হোস্ট ডিরেক্ট থেরাপি’।

ইন্দ্রনীলদের আশা, বর্তমানের ভাইরাস স্ট্রেনগুলো তো বটেই, আগামী দিনে যদি মিউটেশনের ফলে আরও শক্তিশালী ভাইরাস স্ট্রেন তৈরি হয়, নতুন আতিমারির আশঙ্কা দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রেও ভাইরাসগুলিকে সক্রিয় ভাবে রুখে দিতে পারবে নতুন এই থেরাপি। এখন গবেষণাগারের মূল অনুসন্ধান পর্ব শেষ। পরের পরীক্ষা মানবশরীরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Covid -19 India Science Medical Science
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE