বৈসরনের সঙ্গে আজ আমার দেখা হয়নি। কারণ দেখা হওয়ার সব রাস্তাই বন্ধ।
গত কাল এসেছি পহেলগামে। এত দিনের জীবনে সম্পূর্ণ অচেনা লেগেছে এই শহরকে। অনেক রাত অবধি ঘুম আসেনি। সকাল হতেই চিন্তাগুলো ঝাঁপিয়ে আবার পড়ল। বৈসরনে জঙ্গি হামলার এক মাস পূর্ণ হল আজ। এক বার দেখব না, মাস পূর্ণ হওয়ার দিনে কেমন আছে ভারতের ‘মিনি সুইৎজ়ারল্যান্ড’?
সবাই জানেন, পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে ছাড়া বৈসরনে পৌঁছনো যায় না। একটা রাস্তা এখানে ওঠে পহেলগাম থেকে, অন্যটা আসে চন্দনবাড়ি থেকে। দু’টো রাস্তার মুখেই এখন কাঁটাতারের ব্যারিকেড। সেখানে সিআরপি আর জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের পাহারা। এক বন্দুকধারী এগিয়ে এলেন। সোজা কথা তাঁর, ‘‘আর এগোবেন না।’’ বৈসরনে যাওয়া যাবে না? সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এ বার জওয়ান বললেন, ‘‘গত মাস থেকে কাউকে ওখানে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। উপরমহলের নির্দেশ।’’
অগত্যা ফিরতে হল। ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, কেমন আছে বৈসরন? এই যে কারও পা পড়ছে না গত এক মাস ধরে, নিশ্চয়ই পাহাড়ি পায়ে-চলা পথগুলোতে ঘাস গজিয়ে গিয়েছে। মাটিতে মিলিয়ে গিয়েছে টাট্টুঘোড়াদের খুরের দাগ। বেঞ্চিগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। বৈসরনে পৌঁছে যে রেস্তরাঁগুলোয় পর্যটকেরা খাওয়াদাওয়া করতেন, সেগুলোয় তো গত ২২ এপ্রিলের পর থেকেই তালা পড়ে যাওয়ার কথা। পুলিশের থেকে জানা গেল, বৈসরনে যাওয়ার পথের পাশে থাকা গোটা কুড়ি দোকানও আপাতত বন্ধ।
তখনই লাইনটা মাথায় এল— কাঁটাতারে বন্দি স্বর্গের উপত্যকা।
কত পার্ক আছে এখানে! বৈসরন, চন্দনবাড়ি, বেতাব উপত্যকা, আরু উপত্যকার মতোই পহেলগামের ল্যাভেন্ডার পার্ক, পোশওয়ান পার্ক, লিডার ভিউ পার্ক, ক্লাব পার্কে পর্যটকদের ভিড় জমত। সে সব যেন এখন পূর্বজন্মের স্মৃতি! সব ক’টা পার্কের দরজা বন্ধ। মালিরা আসেন তো? না কি পার্কের ভিতরে ঘাস বাড়ছে অযত্নে? দোলনাগুলোতেও মরচে পড়ছে কি না, কে বলতে পারে! প্রায় ফাঁকা পহেলগামের বাজারে দাঁড়িয়ে বিজেপির অনন্তনাগের জেলা সভাপতি রাকেশ কৌল বলছিলেন, ‘‘প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিলাম পার্কগুলো খুলে দিতে। ওঁরা ঝুঁকির কথা বললেন।’’ নিরাপত্তার অভূতপূর্ব কড়াকড়ির জেরে স্থানীয় মানুষের বিপুল আর্থিক ক্ষতির কথাবলছিলেন রাকেশ। বলছিলেন, ‘‘কোনও মতে টেনেটুনে পেট চালাত লোকগুলো।’’
বৈসরনে হামলার ঠিক পরে আতঙ্কিত পর্যটকদের উদ্ধার করায় বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন এখানকার টাট্টু ঘোড়াওয়ালারা। এক ঘোড়াওয়ালাকেও জঙ্গিরা খুন করেছিল। এখন বৈসরনের দরজা বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ঘোড়াওয়ালাদেরই। তাঁরাই ছিলেন বৈসরন-পর্যটনের মেরুদণ্ড। এখানকার ঘোড়াওয়ালাদের সংগঠনের সচিব আব্দুল ওয়াহিদ ওয়ানি বললেন, ‘‘প্রায় ৫০০০ টাট্টু ঘোড়া আছে পহেলগামে। সেগুলোর উপরে রুজিরুটি নির্ভর করে প্রায় সাত হাজার পরিবারের। এরা সবাই এখন রাতারাতি বেকার।’’
উপার্জন বন্ধের দুশ্চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যখন-তখন তদন্তকারী সংস্থার তলব। ঘোড়াওয়ালাদের সংগঠনের সভাপতি বশির আহমেদ দার এখন ঘাস কাটার কাজ করে সংসার টানছেন। বশির বলছিলেন, ‘‘হামলা হওয়া ইস্তক তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কুড়ি বারেরও বেশি ফোন পেয়েছি। এখন ফোন বাজলেই চমকে উঠি— হয় পুলিশ, নয় এনআইএ।’’ ডেকে পাঠিয়ে কী জানতে চাওয়া হয়? বশির জানালেন, বিভিন্ন ছবি দেখানো হয়। সকাল ৮টায় থানায় হাজিরা দিলে সব সেরে ফিরতে ফিরতে এক-এক সময়ে রাত ৯টাও বেজে যায়।
রাত...! পহেলগামে এখন রাতও আসে ভয় আর নৈঃশব্দ্যে ভর করে।
গত কাল তখন সন্ধে বড়জোর ৭টা হবে। কিছু ফল এনে রাখব বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে রওনা হয়েছিলাম পহেলগাম বাজারের দিকে। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, মনে হচ্ছিল একটা ভূতুড়ে শহরে হাঁটছি। এই সে দিনও পহেলগামের বড় রাস্তাটা রাত অবধি মানুষের ভিড়ে গমগম-ঝলমল করত। আর কাল? সেই একই রাস্তায় পথবাতিগুলো সব নিভে গিয়েছে। অন্ধকার রাস্তাটা ফাঁকা। কোনও বাড়ির জানলা গলে একচিলতে আলো আসছে না। মানুষের গলা পর্যন্ত নেই। শুধু নিজের পায়ের আওয়াজ শুনছিলাম। আর সব চুপ।
কাল এখানে পৌঁছতেই স্থানীয় দু’এক জন আমাকে বলেন, ‘‘সাতটার পরে বাইরে বেরোবেন না।’’ কেন? উত্তরটা দিয়েছিলেন হোটেলের এক কর্মী— ‘‘লোকজন ভয় পায়, এই হয়তো জিজ্ঞাসাবাদ বা কোনও ঝুটঝামেলায় পড়তে হবে।’’ আসলে এই অঘোষিত কার্ফুর শহর থেকে শুধু পর্যটকেরাই মিলিয়ে যাননি, স্থানীয় মানুষেরাও রাতের বেলা দরজা-জানলা এঁটে পর্দা টেনে দিয়েছেন। আমার কপাল ভাল, এক ফলওয়ালাকে পেয়ে গিয়েছিলাম। দোকান বন্ধ করার মুখে তিনি বললেন, ‘‘আগে তো সন্ধে-রাতটাই ছিল আমাদের ব্যবসার সময়। কত পর্যটক আসতেন! আর এখন যেন যুদ্ধ-পরিস্থিতি।’’
হোটেলে ফিরে জানলার ধারে বসি। বাইরের এই ঘুমন্ত পহেলগামকে আমি চিনি না। এত ভয়, এত সন্দেহ, এত অবিশ্বাস এখানে ছড়িয়ে দিয়ে গেল কে? সন্ত্রাসের ছায়ায় ঢাকা মুখ, আর গলায় নিরাপত্তার ফাঁস— এর পরেও প্রাণ বেরোবে না পহেলগামের!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)