Advertisement
E-Paper

ট্রেনে মৃত্যু, শেষ সফরে আগলালেন সহযাত্রীরাই

রবিবার সকালে যশবন্তপুর-কামাখ্যা বাতানুকূল এক্সপ্রেসের বি-২ কামরার এই দৃশ্য ওই ট্রেনের এবং বিভিন্ন স্টেশনের সকলকেই অভিভূত করে দিয়েছে। পথেঘাটে অসুস্থ-আতুরকে দেখে নিজের নিজের কাজে চলে যাওয়ার অসাড় উদাসীনতাই যখন ভিড়ের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে দূরসফরে মানবিকতার এই নিশান চমকে দিয়েছে রেলের কর্মী-অফিসারদেরও।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২০
ছুটে চলেছে এক্সপ্রেস ট্রেন। নীচের বার্থে স্বামীর মৃতদেহ আগলে বসে রয়েছেন স্ত্রী। আর দু’জনকেই আগলে রেখেছেন সহযাত্রীরা।

ছুটে চলেছে এক্সপ্রেস ট্রেন। নীচের বার্থে স্বামীর মৃতদেহ আগলে বসে রয়েছেন স্ত্রী। আর দু’জনকেই আগলে রেখেছেন সহযাত্রীরা।

রবিবার সকালে যশবন্তপুর-কামাখ্যা বাতানুকূল এক্সপ্রেসের বি-২ কামরার এই দৃশ্য ওই ট্রেনের এবং বিভিন্ন স্টেশনের সকলকেই অভিভূত করে দিয়েছে। পথেঘাটে অসুস্থ-আতুরকে দেখে নিজের নিজের কাজে চলে যাওয়ার অসাড় উদাসীনতাই যখন ভিড়ের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে দূরসফরে মানবিকতার এই নিশান চমকে দিয়েছে রেলের কর্মী-অফিসারদেরও। যাত্রীদের চাপে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে রেল।

রেলকর্তারা বলছেন, দূরপাল্লার ট্রেনে কোনও যাত্রীর মৃত্যু হলে অন্য যাত্রীদের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছন্দ সফরের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী স্টেশনে মৃতদেহ নামিয়ে ট্রেনের পিছনের মালবাহী কামরায় তা সরিয়ে দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু এ দিন তার ব্যতিক্রম ঘটাতেই হয়েছে। কামরায় সহযাত্রীরা নিজেরাই এগিয়ে এসে মুচলেকা দিয়ে রেলকে জানিয়ে দেন, ওই প্রৌঢ়ের দেহ থাকবে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেই। এবং তাঁদের সঙ্গে থাকবেন কামরার অন্য যাত্রীরাও। কোনও অসুবিধা নেই।

রেল সূত্রের খবর, মৃতের নাম কাশীনাথ তালুকদার (৫৪)। গুয়াহাটির দানাপুরের ওই বাসিন্দা ভেলোরে চিকিৎসা করিয়ে শনিবার বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ কাটপাডি স্টেশন থেকে স্ত্রী অনামিকা তালুকদারকে নিয়ে যশবন্তপুর-কামাখ্যা বাতানুকূল এক্সপ্রেসের বি-২ কামরায় উঠেছিলেন। আজ, সোমবার কামাখ্যা স্টেশনে পৌঁছনোর কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু কটকের কাছে চলন্ত ট্রেনেই ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন কাশীবাবু। ছুটে আসেন টিকিট পরীক্ষক। সাহায্য করেন সহযাত্রীরা। টিকিট পরীক্ষক জয়দীপ বসু বলেন, “এক যাত্রী এবং আমি ওঁর বুকে পাম্প করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি সাড়া দেননি। বালেশ্বরে ট্রেন দাঁড়ালেও ওই স্টেশনে চিকিৎসক ছিল না। তখন ওঁদের নেমে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কামরার অন্য যাত্রীরা নামতে দেননি।”

রেলের চিকিৎসকেরা আসেন রবিবার বেলা ২টো নাগাদ ট্রেনটি খড়্গপুরের কাছে হিজলি স্টেশনে থামার পরে। তাঁরাই কাশীবাবুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। রেলের তরফে মৃতদেহ নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিয়মটি যাত্রীদের জানানো হয়। কিন্তু সহযাত্রীরা মৃতের স্ত্রীকে ট্রেন থেকে নামতে দেননি। তাঁরা রেল-কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন, মৃতদেহের সঙ্গে যেতে তাঁদের কোনও অসুবিধা নেই। মুচলেকা লিখে দেন তাঁরা। সব মিটে যাওয়ার পরে বেলা পৌনে ৩টে নাগাদ ট্রেন ফের যাত্রা শুরু করে।

মৃতের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, কাশীবাবু গুয়াহাটির ব্যবসায়ী। বেশ কয়েক মাস ধরে যকৃতের সমস্যায় ভুগছিলেন। ভেলোরে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় চিকিৎসকেরা। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে ভেলোর রওনা হন তিনি। চিকিৎসার পরে শনিবার ফিরছিলেন। মৃতের স্ত্রী অনামিকাদেবী বলেন, “ভেলোরে দেখানোর পরে চিকিৎসক ওষুধ দিয়েছিলেন। সেটা খাচ্ছিলেনও। কিন্তু বালেশ্বরের আগেই আবার ওঁর শরীর খারাপ হয়। তার পরে সব শেষ। সহযাত্রীরাই সব কিছু করছেন।”

টিকিট পরীক্ষকেরা এ দিন চলন্ত ট্রেন থেকেই বালেশ্বর স্টেশনের কর্তৃপক্ষকে ওই ঘটনার কথা জানান। ট্রেন বালেশ্বরে পৌঁছলে স্টেশন ম্যানেজার কামরায় এলেও কোনও চিকিৎসক আসেননি বলে জানান ওই কামরার যাত্রীরা। পরে হিজলিতে ট্রেন পৌঁছনোর পরে চিকিৎসক এসে ওই যাত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিয়ম মেনে ওই স্টেশনেই মৃতদেহটি নামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন রেল-কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ট্রেনের অন্য যাত্রীরা বাধা দেন। ওই কামরার নুর আলি, কৃষ্ণ বরা এবং অন্যেরা বলেন, “কাশীবাবুর সঙ্গে শুধু ওঁর স্ত্রী ছিলেন। এই অবস্থায় আমরা তাঁকে কী ভাবে একা ছেড়ে দিতে পারি!’’

ছেড়ে যে তাঁরা দিতে পারেন না, সদ্যোমৃত এবং তাঁর শোকার্ত স্ত্রীর সহযাত্রী হয়ে তার প্রমাণ দিয়েছেন নুর আলিরা। গণ-মহানুভবতার কাছে পিছু হটেছে রেলের নিয়ম।

খড়্গপুরের ডিআরএম রাজকুমার মঙ্গলা বলেন, “এত দিন আমরা দেখেছি, ট্রেনে কোনও যাত্রী মারা গেলে সহযাত্রীরা তাঁর মৃতদেহ নামিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। রেল-কর্তৃপক্ষকে আবেদন-নিবেদন জানাতে থাকেন। কিন্তু এ দিন হল ঠিক উল্টোটাই। সহযাত্রীরাই মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুচলেকা দিলেন। এটা নজিরবিহীন।” দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘‘সহযাত্রীদের এমন মানবিক মুখ দেখে আমরাও গর্বিত।’’

তবে ট্রেনটির কামাখ্যায় পৌঁছনোর কথা সোমবার বেলা ৩টে নাগাদ। তত ক্ষণ মৃতদেহটি ওই কামরায় রাখা যাবে কি না, সেই ব্যাপারে সংশয় আছে বলে জানান রেলকর্তারা। রেল সূত্রের খবর, ওই কামরার বেশির ভাগ যাত্রী মানবিকতা দেখাচ্ছেন। এমনটা সাধারণত দেখা যায় না ঠিকই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে কয়েক জন যাত্রী ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন। আর সেটাই চিন্তায় ফেলেছে রেল প্রশাসনকে।

national news train death passenger
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy