Advertisement
E-Paper

পাহাড় কেটে নিজের রাস্তা নিজেই বানালেন কেরলের পঙ্গু ‘বোকাবুড়ো’

এ যেন সেই চিনের লোকগাথা। সেই যে, বোকাবুড়োর পাহাড় সাফ করার গল্প। হাতে গাঁইতি নিয়ে কোমর বেঁধে পাহাড় সাফের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। একা একটা পাহাড় সাফ করা কি সম্ভব? বোকাবুড়ো জানিয়েছিলেন, শুরুর কাজটা তো হল। এ বার বাকিরা সে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৭ ১৪:২২
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

এ যেন সেই চিনের লোকগাথা। সেই যে, বোকাবুড়োর পাহাড় সাফ করার গল্প। হাতে গাঁইতি নিয়ে কোমর বেঁধে পাহাড় সাফের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। একা একটা পাহাড় সাফ করা কি সম্ভব? বোকাবুড়ো জানিয়েছিলেন, শুরুর কাজটা তো হল। এ বার বাকিরা সে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

কিন্তু, কেরলের এক আধাপঙ্গু বৃদ্ধ একাই একটা পাহাড় কাটার কাজ শেষ করে ফেলেছেন। তিন বছর ধরে পাহাড় কাটছেন তিনি। প্রতি দিন, একটু একটু করে। শেষমেশ সেই পাহাড় কেটেই বেরিয়ে এল রাস্তা। যা খুলে দিতে পারে আধাপঙ্গু ওই বৃদ্ধের ভবিষ্যতের ভাগ্য-পথও! শুনে মনে পড়তে পারে বিহারের দশরথ মাজিঁর কথা। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই যাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। একটা পাহাড়ের কারণে অনেক কিলোমিটার ঘুরে তবে স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতাল পৌঁছেছিলেন তিনি। আর সেই দেরির কারণে আর বাঁচানো যায়নি তাঁকে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে জেদের বশে নিজেই সেই পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছিলেন দশরথ।

সিনেমায় দশরথ মাজিঁর ভূমিকায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। ছবি: সংগৃহীত।

তবে বোকাবুড়ো বা দশরথ, দু’জনেই ছিলেন শারীরিক ভাবে সক্ষম। আর কেরলের তিরুঅনন্তপুরমের শশী জি আধাপঙ্গু। তাঁর একটা করে হাত ও পা এক্কেবারে অচল! বড়সড় ওই পাহাড় কাটতে তাই মূলত বাঁ হাতটাই ছিল তাঁর ভরসা। কারণ অন্য হাতটা তো কর্মক্ষম নয়! কাজ করা তো দূরের কথা, ওই হাতটি ভাল করে নাড়তেও পারেন না। ঠিক যেমন ডান পা-টাও কাজ করে না। তাই হাঁটতেও পারেন না ঠিক করে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত সেই শরীর নিয়ে দিনের পর দিন তিনি কেটে গিয়েছেন পাহাড়। কারণ, তাঁর বাড়ি অবধি একটা রাস্তা চাই। সেই রাস্তাই তাঁকে এনে দিতে পারে একটা তিন চাকার গাড়ি। যে গাড়ি ঘুরিয়ে দেবে তাঁর ভাগ্যের চাকা। রাস্তার কাজ এখন প্রায় শেষ। আপাতত পরের অংশটুকু নিয়েই আশায় বুক বেঁধেছেন ওই বৃদ্ধ।

এখন তাঁর বয়স ৫৯। আধাপঙ্গু। কিন্তু, একটা সময় ছিল যখন তিনি নারকেল গাছ বেয়ে তর তর করে উঠে যেতেন। সে যত লম্বাই হোক না কেন! পেড়ে দিতেন ডাব। নারকেলও। ফলন যাতে ভাল হয়, সে জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিতেন গাছ। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ঘুরে ঘুরে এই কাজই করতেন তিনি। কিন্তু, ১৮ বছর আগে হঠাত্ এক দিন সকালে কাজ করতে গিয়ে লম্বা এক নারকেল গাছ থেকে পড়ে গেলেন। হাসপাতালে যমে-মানুষে টানাটানির পর জিতে গেলেন শশী। কিন্তু, খোয়ালেন একটি হাত-পায়ের সক্ষমতা। আধাপঙ্গু হয়ে গেলেন। অনিশ্চিত হয়ে পড়ল সংসার। দু’বেলার দু’মুঠো খাবারও।

তখন তিনি শয্যাশায়ী। চিকিত্সকের নির্দেশ। দুশ্চিন্তার মেঘ কপালে। কোনও কাজ নেই। চূড়ান্ত আর্থিক সঙ্কট। কাজ করার ক্ষমতাও নেই। মনে মনে ভেঙেচুরে রয়েছেন। কয়েক মাস পর থেকে কোনও রকমে হেঁটে ঘরের বাইরে আসার শুরু। আর বাকিটার জন্য একমাত্র ভরসা তাঁর স্ত্রী। এমন সময়ে একটা ভাবনা মাথায় আসে শশীর। স্থানীয় পঞ্চায়েতের কাছে একটা তিন চাকার গাড়ি চাইলে কেমন হয়? সেই গাড়ি চালিয়েই তো তিনি ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করতে পারেন। তাতে তো বেঁচে যেতে পারে সংসারটা। সঙ্কটটাও কেটে যেতে পারে। এর পরেই তিনি পঞ্চায়েত প্রধানকে একটা চিঠি দিলেন। জানালেন তাঁর প্রস্তাব। কিন্তু, পঞ্চায়েত সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেয়। জানিয়ে দেয়, পক্ষাঘাতগ্রস্ত কোনও ব্যক্তিকে গাড়ি দেওয়ার কোনও নিয়ম নেই। এবং কোনও কারণও নেই। তা ছাড়া, শহরতলীর বাইরের ওই গ্রামে পাহাড় পেরিয়ে শশীর বাড়িতে তিন চাকার গাড়ি ঢোকার মতো কোনও রাস্তা নেই। যে সরু এক ফালি পথ রয়েছে, তাতে কোনও রকমে হেঁটে যাওয়া সম্ভব। ফলে, গাড়ি মিলল না!

আরও পড়ুন
দশরথকে চেনাতেই ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’ বলছেন নওয়াজউদ্দিন

শরীর গিয়েছে বলে, মনের দিক থেকে এক্কেবারেই দমে যাননি শশী। তিনি এ বার পঞ্চায়েতকে রাস্তা বানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। পঞ্চায়েত তা খারিজ করল না। বরং নিশ্চিত ভাবেই জানিয়ে দিল, রাস্তা মিলবে। কিন্তু, দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। রাস্তা আর হয় না। পাহাড় কেটে কী ভাবেই বা হবে! বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর শশী নিজেই সে কাজে হাত দিলেন। গত তিন বছর ধরে প্রতি দিন শাবল, কোদাল, গাঁইতি নিয়ে এক হাতের ভরসায় কেটে গিয়েছেন পাহাড়। রোজ নিয়ম করে ৬ ঘণ্টা। রোদ্দুর, ঝড়, বৃষ্টি— সব উপেক্ষা করে লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন। পাখির চোখ করেছেন রাস্তাকে। রাস্তা হলে তবেই তো বাড়ি অবধি পৌঁছবে তিন চাকার গাড়ি!

প্রথম দিকে পাড়ার লোকজন হেসেছে। ‘ও ভাবে হয় নাকি’, ‘আরে নিজের ক্ষমতাটাও তো বুঝতে হবে’, ‘জেদের বশে বুড়োটা নিজের জীবন নিয়ে খেলছে’, ‘পারবে না, কেন এ সব পাগলামো করছো’— এমন নানা বাক্য উড়ে এসেছে। তবুও দমেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি শুধু রাস্তা কেটে গিয়েছি। কারণ, সকলে ভেবেছিল আমি পারব না। নিজেকে নিজের কাছেই প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া, এটা আমার ফিজিওথেরাপির কাজও করত। পঞ্চায়েত আমাকে গাড়ি দেয়নি। আমি গ্রামবাসীকে একটা রাস্তা তো দিতে পারলাম। সেটাই বা কম কিসের!’’

গ্রামের অন্যান্যরাও খুশি। সুধা নামে এক মহিলা বলছিলেন, ‘‘আমরা তো ওই পাহাড় টপকাতে পারতাম না কোনও দিন। পাশ কাটিয়ে কোনও রকমে পাহাড় ঘেঁষে চলতাম। আর ভাবতাম, এই মানুষটা কী ভাবে পারবে! শেষ পর্যন্ত ওঁর জয় হল। ভাল লাগছে।’’ খুশি শশীর স্ত্রী-ও। ভেজা চোখে বললেন, ‘‘কত বার বারণ করেছি। কোরো না। আবার কিছু একটা হয়ে গেলে, চিকিত্সা করানোর একটা পয়সাও নেই কাছে। ধারদেনায় গলা অবধি ডুবে আছি। শেষ পর্যন্ত ও জেদ বজায় রেখেছে। সফল হয়েছে।’’ স্ত্রী যখন এ কথা বলছেন, তখন তাঁর পাশে বসে আশাবাদী শশীর প্রশ্ন, ‘‘আর মাসখানেকের কাজ বাকি। রাস্তার এক দম শেষ পর্যায়ে রয়েছি। কিন্তু, পঞ্চায়েত কি আমাকে একটা তিন চাকার গাড়ি দিতে পারে না?’’

‘বোকা’ এই বুড়োর গল্প কি পঞ্চায়েতকে উদ্বুদ্ধ করবে না? এখনও তা জানেন না কেরলীয় ওই বৃদ্ধ।

আরও পড়ুন
খাবার নিয়ে ভিডিও-নালিশ জওয়ানের, রিপোর্ট তলব

Sashi G Kerala Mountain Man
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy