তাঁর মন্তব্যকে বিকৃত করে ‘বাঙালি-বিরোধী’ বলে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে! তৃণমূল শিবিরের প্রশ্নের মুখে এমনটাই দাবি করলেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে হিমন্তের একটি মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক ছড়ায়। অসমে জনগণনার সময়ে মাতৃভাষা বাংলা লিখলেই অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে? এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। প্রশ্ন তোলে তৃণমূলও।
এই বিতর্কের আবহে এ বার ব্যাখ্যা দিলেন হিমন্ত। তাঁর দাবি, অসমে বসবাসকারী বাংলাভাষী-সহ প্রত্যেক ভারতীয় তাঁর সরকারের অবস্থান বোঝেন। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে অসম সরকারের অবস্থানকে তাঁরা সমর্থনও করেন। একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, তৃণমূল তাঁর মন্তব্যকে ‘বিকৃত’ করছে। তাঁকে ‘বাঙালি-বিরোধী’ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের আড়াল করার জন্য মরিয়া চক্রান্তের জন্যই তৃণমূল তাঁর মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করছে।
অস্বস্তি কাটাতে নিজের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেন তিনি। সমাজমাধ্যমে তিনি লেখেন, অসম কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই অনুপ্রবেশকারীদের উপস্থিতি দেশের জনসংখ্যার কাঠামোকে বদলে ফেলতে পারে। নিজের ওই পোস্টটিতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক (সাংগঠনিক) সুনীল বনসলকেও ট্যাগ করেছেন হিমন্ত।
কোন মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক?
অসমের এক সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতা মইনুদ্দিন আলি সম্প্রতি দাবি করেন, সে রাজ্যে বসবাসকারী পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা জনগণনার সময়ে মাতৃভাষা হিসাবে বাংলাকেই নথিভুক্ত করবেন। এর ফলে অহমিয়া আর সে রাজ্যের প্রধান ভাষা থাকবে না বলে দাবি মইনুদ্দিনের। ‘টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’ অনুসারে ওই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে হিমন্ত জানান, অসমের সরকারি ভাষা আইনত অহমিয়াই থাকবে। তবে মইনুদ্দিনের কথামতো কাজ করলে আসলে বিনা নথিতে অসমে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করতে সুবিধা হবে। তাঁর মন্তব্যের এই অংশ ঘিরেই বিতর্ক দানা বাঁধে।
ওই সময় হিমন্ত আরও বলেন, “জনগণনার সময় একটি ভুল ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, কথ্য ভাষাটিই গুরুত্বপূর্ণ। তার পরে সংখ্যালঘুদের একাংশ সেটি নিয়ে চাপ দিতে শুরু করে যে তারা অহমিয়ায় কথা বলবে না। যদি আপনি বাড়িতে বাংলায় কথা বলেন, তা হলে অহমিয়ায় কথা বলেন— এই ভুল তথ্য কেন দেবেন? জনগণনার সময় ভুল তথ্য দেওয়া অপরাধ।” অসমের মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, অসমের নদীতীরবর্তী এলাকায় অনেক বাঙালি সংখ্যালঘু বাস করেন। তাঁরা অতীতেও জনগণনার সময় মাতৃভাষা হিসাবে বাংলাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ সেই সময় অহমিয়াকে মাতৃভাষা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। এই ৩০ শতাংশের মধ্যে অসমের আদি বাসিন্দা সংখ্যালঘুদের সংখ্যাই বেশি বলে দাবি হিমন্তের। তিনি বলেন, “অন্য জায়গা থেকে আসা সংখ্যালঘুরা সব সময়ে নিজেদের মাতৃভাষা হিসাবে বাংলাকেই বেছে নেন। এই হুমকি নতুন নয়।”
আরও পড়ুন:
হিমন্তের মন্তব্যে প্রশ্ন তৃণমূলের
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে বিজেপিশাসিত কিছু রাজ্যে শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। হিমন্তের এমন মন্তব্যের পরে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্যও। হেমন্তের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি? হিমন্তবাবু, লজ্জা করে না? আপনি যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সেই রাজ্যের দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি বলা ভাষা বাংলা। সম্ভবত (অসমের) ৪০ শতাংশের উপরে মানুষ বাংলাভাষী।” মাতৃভাষা বাংলা লিখলে বাংলাদেশি বাছতে সুবিধা হবে বলে যে মন্তব্য করেছেন হিমন্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন দেবাংশুর। তিনি বলেন, “তার মানে বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশি?” পশ্চিমবঙ্গ যে ভারতেরই অঙ্গ এবং এ রাজ্যের মানুষ যে বাংলায় কথা বলেন, তা-ও হিমন্তকে স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। তাঁর প্রশ্ন, “পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, তার কোনও দাম নেই?” দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বিপ্লবীদের অবদানও স্মরণ করিয়ে দেন দেবাংশু।
মঙ্গলবার হিমন্তের সমাজমাধ্যম পোস্টের পরে আবার তাঁকে নিশানা করেছেন দেবাংশু। হিমন্তের পোস্টটিকে তাঁর ‘ভাষাগত উগ্রতা’কে আড়াল করার চেষ্টা হিসাবেই দেখছেন তিনি। হিমন্তকে বিঁধে তিনি লিখেছেন, “আপনি বলছেন যে আপনার সরকারের নিশানায় শুধুমাত্র ‘অবৈধ বাংলাদেশি মুসলিমেরা। কিন্তু জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে যে ১৯.৬ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ১২ লক্ষ বাঙালি হিন্দু। তাঁদের কি ধর্মীয় বিশ্বাসে সমস্যা ছিল? না কি ভাষায়? আপনি বলছেন, আপনার লড়াই বাঙালিদের বিরুদ্ধে নয়। তা হলে যে অসমের ডিটেনশন সেন্টারে মৃত ৩০ জনের মধ্যে চার জন ছাড়া বাকিরা সকলেই বাংলাভাষী ছিলেন, তা নিয়ে আপনি কী বলবেন?” দেবাংশুর অভিযোগ, হিমন্তের এই কাজকর্মের সঙ্গে অবৈধবাসের কোনও সম্পর্ক নেই। এটি আসলে একটি ভাষা, একটি শ্রেণির মানুষ এবং একটি সংস্কৃতির মানুষের প্রতি হিমন্তের ঘৃণাকেই প্রতিফলিত করে।