দেবীপক্ষের আগমনের দিনেই বিসর্জনের সুর অসমজুড়ে!
মহালয়ার সকালে শহরে পৌঁছালো অসমের প্রাণ জ়ুবিন গর্গের প্রাণহীন দেহ। ৩৩ বছর ধরে অসমিয়া যুবার যত প্রেম, স্পর্ধা, রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, যত বলতে চেয়েও বলতে না পারা কথা- সেই সব কিছু সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন জ়ুবিন গর্গ।
প্রিয় গায়কের গান গেয়ে সারা রাত অপেক্ষা করেছে জনসমুদ্র। বিমানবন্দরের বাইরে থেকে শুরু করে কাহিলীপাড়ার বাড়ির বাইরে পর্যন্ত। সারি সারি মানুষ শুয়ে থাকেন রাস্তায়! রবিবার সকাল পৌনে সাতটায় বিমানবন্দর থেকে জ়ুবিনের শববাহী গাড়ি বেরিয়ে আসামাত্র যে জয়ধ্বনি শুরু, তা রাত পর্যন্ত চলছে। গাড়ির সামনে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছিলেন খোদ ডিজিপি হরমিত সিংহ। দেহ নিয়ে দিল্লি থেকে এসেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পবিত্র মার্গারিটা। বিমানবন্দর থেকে মরদেহ আসে কাহিলীপাড়ার বাড়িতে। রাস্তায় বিছিয়ে রাখা ছিল ফুল।
জ়ুবিনের স্ত্রী গরিমা শইকিয়া গর্গ বিমানবন্দর থেকেই জ়ুবিনের শেষ যাত্রার সঙ্গী হয়েছেন। কাহিলীপাড়ায় বাবা মোহিনী মোহন বরঠাকুর ছেলেকে শেষ আদর করে বলেন, “আমি বোধহয় একমাত্র বাবা যে ছেলের জীবনী লিখবে।”
সেখান থেকে মরদেহ নেওয়া হয় সরুসজাই স্টেডিয়ামে। রাত থেকে দাঁড়ানো জনসমুদ্র সামলাতে নাজেহাল হয় পুলিশ-প্রশাসন-আধা সেনা। প্রিয় শিল্পীর মরদেহ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ে জনতা। একই সঙ্গে আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি। ফোটে জোড়া রামধনু।
২০১১ সালের ৯ নভেম্বর। শেষ বার এমন জনজোয়ারে ভেসেছিল শহর। মুম্বই থেকে গুয়াহাটি এসে পৌঁছেছিল ভূপেন হাজরিকার নশ্বর দেহ। কিন্তু ‘ভূপেনদা’ চলে গেলেও অসমবাসীর ভরসা ছিল, আমাদের ‘জ়ুবিনদা’ আছেন। এখন তো বিরাট শূন্যতা! জাতির এমন সর্বজনমনঅধিনায়ক বলতে আর তো কেউ থাকলেন না। ভূপেন হাজরিকা দীর্ঘদিন অসমের বাইরে ছিলেন। বয়স হয়েছিল। ছিলেন অসুস্থ। কিন্তু জ়ুবিন? এই সেদিন ঘোড়ায় জিন দিয়ে রওনা হয়েছিলেন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। ফেরার কথা ছিল ২১ সেপ্টেম্বর। সেই দিনেই ফিরলেন। কিন্তু টগবগিয়ে নয়, কফিনবন্দি হয়ে!
সিঙ্গাপুরে, মৃত্যুর আগের রাতে স্থানীয় হোটেলে গায়িকার মাইক টেনে নিয়ে তিনি ধরেছিলেন এরিক ক্ল্যাপটনের গান ‘টিয়ার্স ইন হেভেন’। ভাইরাল ভিডিয়োর লাইনগুলোর তর্জমা করলে দাঁড়ায়-
যদি স্বর্গে তোমাকে দেখি,/তুমি আমায় নামে চিনবে কি?/যদি স্বর্গে তোমাকে দেখি, তুমি আমার হাত ধরবে কি?/দরজার ওই পারে জানি,/শান্তি আছে, আমি মানি/তবু, দিন-রাত পার হয়ে ঠিক,/আমি ঠিকই খুঁজে নেব দিক/আমি ফের ফিরব নিশ্চয়ই,/স্বর্গে থাকার বান্দা আমি নই।
তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই, তিনি পাড়ি দিলেন যেতে না চাওয়া সেই গন্তব্যের পথে।
জ়ুবিনের মৃত্যু ঘিরে উত্তর-পূর্ব উৎসবের মূল উদ্যোক্তা শ্যামকানু মহন্তর উপরে জনরোষ চরমে। সিআইডি তাঁকে গ্রেফতার করে অসমে আনার পরিকল্পনা করেছে। এই পরিস্থিতিতে শ্যামকানু জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানালেন, এবছর জ়ুবিন স্বেচ্ছায় ও বিশ্রাম নিতে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন। ঘটনার দিন স্থানীয় অসমিয়া সোসাইটি উদ্যোক্তাদের অজ্ঞাতেই জ়ুবিনকে নিয়ে বেড়াতে যায়। সঙ্গে ছিলেন খুড়তুতো ভাই সন্দীপন গর্গ, ম্যানেজার সিদ্ধার্থ শর্মা ও শেখরজ্যোতি গোস্বামী। সিদ্ধার্থ ফোনে দুর্ঘটনার কথা জানায়। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজে যান। দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলেন। শ্যামকানু বলেন, “আমরা তদন্তে সব ধরণের সহযোগিতা করতে তৈরি।”
৩৮ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করে নজির গড়া জ়ুবিন মৃত্যুতেও নজির গড়লেন। শোকযাত্রায় অংশ নিলেন ১০ লক্ষাধিক মানুষ। লিমকা বুক অব রেকর্ডস অনুযায়ী, শেষযাত্রার জনসমাগমে প্রথম স্থানে আছেন মাইকেল জ্যাকসন, দ্বিতীয় স্থানে পোপ ফ্রান্সিস, তৃতীয় স্থানে রানি এলিজ়াবেথ ও চতুর্থ স্থানে জ়ুবিন। অর্থাৎ ভারতের ইতিহাসে তাঁর প্রয়াণেই জড়ো হলেন সবচেয়ে বেশি মানুষ! ভিড়ের চাপে অনেকেই অসুস্থ ও জখম হন। জনতার চাপ সামলাতে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা ঘোষণা করলেন, কালও জ়ুবিনের দেহ স্টেডিয়ামেই থাকবে। মঙ্গলবার হবে অন্ত্যেষ্টি। জাতীয় শোকের দিনও বাড়ানো হল।
মানুষের ঢল দেখে আপ্লুত গরিমা বলেন, “জুবিন এই ভালোবাসার স্রোত দেখে অভিভূত হত। ও তো আজ আর কিছু বলতে পারছে না, তাই ওর হয়ে আমি প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতা জানাই। জীবনের ও যেটুকু সাফল্য অর্জন করেছে, তার পেছনে ছিল আপনাদের এই অপরিসীম ভালোবাসা। ওঁর সৃষ্টি, ওঁর ভালবাসার তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।”
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা জানান, এত মানুষ জ়ুবিনতে দেখতে এসেছেন, তাই সোমবারেও জ়ুবিন গর্গের অন্ত্যেষ্টি স্থগিত রাখা হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২৩ সেপ্টেম্বর জ়ুবিনের শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কমারকুচির হাতিমুরা এলাকাতে হবে। সেখানে সমাধিক্ষেত্রও তৈরি হবে। জনতার দাবি মেনে, জ়ুবিনের ভস্ম যোরহাটে নিয়ে গিয়ে সেখানেও সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হবে।
হিমন্ত আরও বলেন, “সিঙ্গাপুর থেকে জ়ুবিনের ডেথ সার্টিফিকেট এসেছে। সেখানে মৃত্যুর কারণ ‘জলে ডোবা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একাধিকবার ফোনে খবর নিয়েছেন।”
হিমন্তর কথায়, “জ়ুবিনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে তাঁর ম্যানেজার সিদ্ধার্থ শর্মা ও নর্থ ইস্ট ফেস্টিভালের মূল উদ্যোক্তা শ্যামকানু মহন্তর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫৪টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তাঁরা কেউ এখন অসমে নেই। সিদ্ধার্থের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের জন্য জ়ুবিনের স্ত্রী অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্ত্যেষ্টির পরে ব্যবস্থা নেবে সিআইডি। ঘটনা যেহেতু সিঙ্গাপুরে ঘটেছে তাই তদন্ত সিঙ্গাপুর পুলিশ করছে। বিচারও সেখানেই হবে। আমরা শুধু তদন্ত করব এই ঘটনায় কোনও ষড়যন্ত্র আছে কিনা।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)