যে শিবসেনা মন্দির ভাঙার দায় নিয়েছিল শিবসেনা তাঁদের সঙ্গে জোট করে সরকার চালাচ্ছে কংগ্রেস। ফাইল চিত্র।
১৯৬৮ সালে ভারতের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল সোভিয়েত রাশিয়ায় যায়। পোত্রোগ্রাদ এলাকায় তাঁরা দেখেন, সেখানকার প্রশাসন প্রাচীন ভগ্নপ্রায় গির্জাগুলো পুনর্নির্মাণ করছে। সময়টা ছিল আর্থিক সঙ্কটের। ওই সঙ্কটেও একটা কমিউনিস্ট দেশের নাস্তিক সরকার কেন বিপুল ব্যয়ে গির্জার পুনর্নির্মাণ করছে, তা ভারতীয় প্রতিনিধিদলের কারও কারও মাথায় ঢোকেনি। এক বামপন্থী সাংসদ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ওই ‘অকারণ’ খরচ কেন করা হচ্ছে?
সোভিয়েত রাশিয়ার প্রশাসন জানায়, কোনও ধর্মবিশ্বাসের কারণে ওই গির্জাগুলোর পুনর্নির্মাণ হচ্ছে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বাহিনীর আক্রমণে ওই গির্জাগুলো ভেঙে গিয়েছিল। সেই ক্ষতকে সোভিয়েত রাশিয়া কোনও ধর্মবিশ্বাসের উপরে তৈরি হওয়া ক্ষত বা কোনও ধর্মস্থানের ক্ষতি হিসেবে দেখছে না। দেখছে জাতীয় ক্ষতচিহ্ন হিসেবে। সেই জাতীয় ক্ষতচিহ্ন মুছতেই সরকারি খরচে গির্জাগুলো সারানো হচ্ছে।
অযোধ্যায় রামমন্দিরের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা একই। রামমন্দির আন্দোলন ছিল একটা জাতীয় ক্ষতচিহ্ন মোছার আন্দোলন। রামমন্দিরের কাঠামোর উপরে বাবরি মসজিদের যে গম্বুজ তৈরি হয়েছিল, সেটা ছিল আরব সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক। রামমন্দির আর বাবরি মসজিদ নিয়ে যে টানাপড়েন, তা হিন্দু-মুসলমানের টানাপড়েন নয়। এ হল ভিনদেশি হামলাকারীর সঙ্গে ভারতীয় অস্তিত্বের লড়াই। ভারতের মানুষ বিশ্বাস করেন, রাম অযোধ্যায় জন্মেছিলেন। একজন নাস্তিক বামপন্থী নেতার ছেলেকেও যদি জিজ্ঞাসা করা হয় রাম কোথায় জন্মেছিলেন, তা হলে সে-ও বলবে যে, রাম অযোধ্যায় জন্মেছিলেন। বলবে না, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বারান্দায় জন্মেছিলেন। অর্থাৎ, রামচন্দ্র হলেন ভারতীয়ত্বের প্রতীক। আপামর ভারতবাসীর কাছে তিনি মর্যাদা পুরুষোত্তম। তাঁর মন্দির ভেঙে তার উপরে মসজিদ তৈরি করা আসলে ভরতের জাতীয় পরিচিতির উপরে আঘাত।
যে আরব আগ্রাসন রামমন্দির ভেঙে তার উপরে মসজিদ তৈরি করেছিল, রামের জীবনচরিতে কিন্তু কোথাও সেই আগ্রাসনের স্থান ছিল না। রাবণবধের পরেও তার প্রমাণ মিলেছিল। লক্ষ্মণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন লঙ্কার সৌন্দর্যে। কিন্তু লঙ্কা ছেড়ে যে ফিরতেই হবে, লঙ্কা দখল করার জন্য যে তাঁরা যুদ্ধটা করেননি, সে কথা লক্ষ্মণকে মনে করিয়েছিলেন রাম। মনে করিয়েছিলেন, ‘‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।’’ সেই রামচন্দ্রের জন্মভূমিতে আরব আগ্রাসনের প্রতীক মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে, এটা হতে পারে না! ভারতের মানুষ সেটা মেনে নিতে পারে না।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর জনরোষের চাপে বিতর্কিত কাঠামো গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসে যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিন্তু বার বার জনরোষ এ ভাবেই আছড়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে, প্রবল জনরোষ এমন চেহারাও নিয়েছে যে, বাস্তিল দুর্গও ভেঙে গিয়েছে হাতের চাপে। বাবরিও কিন্তু সে ভাবেই ভেঙেছিল। সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে বিতর্কিত কাঠামো ভাঙা হয়েছিল, এমন কিন্তু নয়। লক্ষ লক্ষ করসেবকের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের তীব্র বহিঃপ্রকাশে সে দিন বিতর্কিত কাঠামো গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। সিবিআই আদালতের রায়েও সেটা প্রমাণ হয়েই গেল।
বাবরি ধ্বংস মামলায় যে রায় সিবিআই আদালত দিয়েছে, তাকে তো স্বাগত জানাচ্ছিই। একই সঙ্গে আডবাণীজিকেও আমরা প্রণাম করছি। এটা তাঁকে প্রণাম করার দিন। লালকৃষ্ণ আডবাণী হলেন এই ভারতের উচ্চতম গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্বদের অন্যতম। বাবরি ধ্বংসের দায় তাঁর বা মুরলীমনোহর জোশীর কাঁধে চাপিয়ে দশকের পর দশক ধরে তাঁদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। যে দিন বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল, সে দিন কিন্তু চোখে জল নিয়ে আডবাণীজি দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। কারণ সেদিন অযোধ্যায় করসেবার ডাক দেওয়া হয়েছিল এবং আডবাণীজিরা কথা দিয়েছিলেন যে, বিতর্কিত কাঠামোকে স্পর্শ করা হবে না। কিন্তু জনরোষ নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। আডবাণীজি কথা রাখতে পারেননি বলে ভগ্নহৃদয়ে অযোধ্যা ছেড়েছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেল।
উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহও একই প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। বাবরি রক্ষা করতে না পারার দায় নিয়ে তিনি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিকেলে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। আর কংগ্রেস সেদিন কী করেছিল? সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ভাবে তিনটে রাজ্যের সরকারকে ভেঙে দিয়েছিল ৩৫৬ ধারা জারি করে! হিমাচল প্রদেশে একটাও গোলমালের ঘটনা ঘটেনি। তবু হিমাচল সরকারকে ভেঙে দিয়েছিল। অথচ যে দল প্রকাশ্যে দাবি করেছিল যে, বাবরি তারাই ধ্বংস করেছে, সেই শিবসেনার সঙ্গে জোট করে কংগ্রেস এখন মহারাষ্ট্রে সরকার চালাচ্ছে। সকলের জেনে রাখা উচিত, অযোধ্যার সেই করসেবায় শুধু বিজেপি বা আরএসএস তো নয়, গোটা সঙ্ঘ পরিবার এবং বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র শিবসেনাই প্রকাশ্যে মসজিদ ভাঙার দায় নিজেদের কাঁধে নিয়েছিল। বালাসাহেব ঠাকরে সোজাসাপ্টা জানিয়েছিলেন, শিবসৈনিকরা অযোধ্যায় বাবরি ভেঙেছেন। এখন সেই দলের সঙ্গে জোট করে কংগ্রেস সরকার চালাচ্ছে। অথচ এত বছর ধরে একনাগাড়ে আডবাণীজিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে গিয়েছে।
অযোধ্যায় সেদিন করসেবকদের স্লোগান ছিল, ‘এক ধাক্কা অওর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’। ওই স্লোগান তুলে ধরে বিজেপি বিরোধীদের দাবি, পরিকল্পিত ভাবেই বিতর্কিত কাঠামো ভাঙা হয়েছিল। কিন্তু ওই স্লোগানে আসলে তা প্রমাণিত হয় না। আন্দোলনের উত্তেজনায় অনেক রকম স্লোগান হয়। সিপিএম তো বরাবর স্লোগান দিয়েছে যে, ‘কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’। তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, সিপিএমের লোকেরা সনিয়া গাঁধীর হাতটা কেটে নিতে চাইছেন বা রাহুল গাঁধীর হাতটা গুঁড়িয়ে দিতে চাইছেন!
বিতর্কিত কাঠামো পরিকল্পিত ভাবে ভাঙা হয়েছিল কি না, সে বিতর্ক নিয়ে অবশ্য এত কথা বলার প্রয়োজন আর নেই। আদালতের রায়ে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে বছরের পর বছর ধরে ভারতবাসীর আস্থাকে যে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, সে কথা এই সন্ধিক্ষণে আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। রামমন্দিরের বিরোধিতা করার জন্য বা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বার বার কংগ্রেস এবং বামেরা রাম জন্মভূমির অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে গিয়েছে। অবশেষে আদালতের নির্দেশে এক জাপানি সংস্থাকে দিয়ে ‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার সার্ভে’ (জিপিআরএস) পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়। অযোধ্যায় বিতর্কিত কাঠামো ঘিরে ২৪টি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পরীক্ষা করা হয়। জাপানি সংস্থাটি জানায়, মসজিদের নীচে বিশালকায় হিন্দু স্থাপত্যের অস্তিত্ব রয়েছে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আদালতের রায়ও হয়েছিল। সুতরাং বাবরি মসজিদের আগে ওই জমিতে রামমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কি না, তা নিয়ে আর বিতর্কের কোনও অবকাশই নেই।
আরও পড়ুন: এত দিনে বাবরি ধ্বংসের রায়! অক্ষমের উল্লাস ছাড়া আর কী?
মসজিদ ভাঙা ঠিক হয়েছিল কি না, তা নিয়ে কথা হতে পারে। পরিকল্পিত ভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকে নিশ্চয়ই সমর্থন করব না। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষ বহুবার পৃথিবীর ইতিহাসকে নানা বাঁকের সামনে দাঁড় করিয়েছে। অযোধ্যায় প্রথম বার ওই রকম কোনও ঘটনা ঘটেছিল, এমন নয়। আর অযোধ্যার ঘটনা যে জনরোষই ছিল, তা আদালতও মেনে নিয়েছে। কংগ্রেস বা বামপন্থীরা এখনও অনেক কিছু মানবেন না। রাম ভারতের আস্থার প্রতীক বা অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জমিতেই রামের জন্ম হয়েছিল, তাঁরা মানবেন না। জনরোষে মসজিদ ভেঙে পড়েছিল, তাঁরা মানবেন না। কিন্তু শিবসেনার সঙ্গে জোট করে সরকার চালাতে পারবেন। রাজীব গাঁধীর আমলে যে বিতর্কিত জমির তালা খোলা হয়েছিল বা নরসিংহ রাওয়ের জমানায় যে অযোধ্যায় করসেবার অনুমতি মিলেছিল, সে সব কথা তুলে ধরে বামেরা কংগ্রেসের বাপান্ত করবেন। আবার পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কংগ্রেস সেই বামেদের হাত ধরেই লড়বে। এটাই হল কংগ্রেসের রাজনীতি তথা নির্লজ্জ দ্বিচারিতা। কংগ্রেস একই সঙ্গে শিবাজি মহারাজ আর আফজল খাঁয়ের হাত ধরতে চায়। কংগ্রেস সব সময় আব-এ-জমজম আর চরণামৃতর একটা ‘অসামান্য ব্লেন্ডিং’ তৈরি করতে চায়।
‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের দিকে আঙুল তুলে বিজেপি-কে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু এই লেখায় আজ ওই স্লোগানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে চাইব। ‘শ্রী’ শব্দের অর্থ সমৃদ্ধি। আর ‘রাম’ হলেন মূল্যবোধের প্রতীক। অর্থাৎ ‘জয় শ্রীরাম’-এর অর্থ হল সমৃদ্ধি ও মূল্যবোধের জয়। সেই স্লোগানকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে দেগে দিয়ে দিনের পর দিন কংগ্রেস ও বামেরা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে চেয়েছে। কিন্তু একটা বিরাট সম্প্রদায়ের আস্থাকে বরাবর আঘাত করে এসেছে।
আরও পড়ুন: ওই দিনটা ছিল দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন, মাতা মেরি কুমারী ছিলেন। কুমারী হলে সন্তানের জন্ম কী ভাবে দিলেন? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এটা প্রশ্ন তোলার বিষয় নয়। এটা আস্থার বিষয়। মাতা মেরি কুমারী ছিলেন এটা প্রমাণ করা হোক, এমন কথা কেউ কি বলেন? তা হলে রামের জন্মস্থান অযোধ্যায় ছিল কি না, তার প্রমাণ দাখিল করতে বলা হবে কেন?
আজ নিশ্চয়ই একটা আনন্দের দিন। অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির কাজ আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এ বার প্রমাণ হল, বিতর্কিত কাঠামো ভাঙার নেপথ্যেও কোনও ষড়যন্ত্র ছিল না। ভারতীয় অস্তিত্বের উপরে যে ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়েছিল, সেই জাতীয় ক্ষতচিহ্ন বোধহয় আজ পুরোপুরি নিরাময় পেল।
(লেখক রাজ্য বিজেপি-র নেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক। মতামতের জন্য আনন্দবাজার ডিজিটাল দায়ী নয়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy