E-Paper

‘মুসলমানরা কি তবে নাগরিক নয়’

দাঁড়িয়ে আছি গুরুগ্রামের সাউথ সিটি টু-এর নিকটবর্তী এলাকা ডি-১ মার্কেটের বাংলা বস্তিতে। অন্য নাম ‘গেন্দানালি জুগ্গি’। কাদা মাড়িয়ে টোটো করে যথাসর্বস্ব নিয়ে এক-একটি পরিবার চলে যাচ্ছে।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৫ ০৭:৩৬
উচ্ছেদের আতঙ্কে গুরুগ্রামের ‘গেন্দানালি জুগ্গি’র বাঙালিরা এখন হাতের কাছেই রাখছেন পরিচয়পত্র।

উচ্ছেদের আতঙ্কে গুরুগ্রামের ‘গেন্দানালি জুগ্গি’র বাঙালিরা এখন হাতের কাছেই রাখছেন পরিচয়পত্র। —নিজস্ব চিত্র।

সকালে জনা দশেকের পুলিশ বাহিনী এসে খুব নম্র ভাবে এই বস্তিতে বলে গিয়েছে, ‘হয় নিজেদের জমির কাগজ দেখাও। নয়তো যে যার গ্রামে ফিরে যাও, যেখান থেকে এসেছিলে। আমরা ভাল মুখে বলে গেলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে না ছাড়লে যারা আসবে তারা কিন্তু এত ভাল করে বলবে না। যা করার করবে।’

দাঁড়িয়ে আছি গুরুগ্রামের সাউথ সিটি টু-এর নিকটবর্তী এলাকা ডি-১ মার্কেটের বাংলা বস্তিতে। অন্য নাম ‘গেন্দানালি জুগ্গি’। কাদা মাড়িয়ে টোটো করে যথাসর্বস্ব নিয়ে এক-একটি পরিবার চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, স্পষ্ট নয়। এই বিসর্জন-দৃশ্যের পাশে গাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা করা হল আর ভয় কাটিয়ে ক্রমশ গলার স্বর চড়তে লাগল ছোট্ট জটলাটির। গঙ্গারামপুর থানা এলাকার মেহেরনাকার বিবি চিৎকার করছেন, হয়তো নিজের ভয়টা কাটানোর জন্যই। ‘‘একটা কোলের, অন্যটা চার বছরের ছেলেকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম কাজের সন্ধানে। ছাব্বিশ বছর হল থেকে গিয়েছি। মেহনত করে ছেলেরা একটা টোটো কিনেছে, চুড়ি মালার দোকান করেছি। আমরা এই জায়গা ছেড়ে যাব না কোথাও। শেষ পর্যন্ত লড়ব। বাংলায় পয়দা হয়েছি, ইংরেজি বলব কী করে? বাপ মা গরিব, এত ভাষা শেখাবে কী ভাবে? কামাচ্ছি খাচ্ছি, এখানের সরকারেরই তো ফায়দা হচ্ছে।’’

মালদহের কালিয়াচক থানা এলাকার সুবিয়া চৌধুরী রাতে ঘুমাতে পারছেন না আতঙ্কে। ‘‘ঠাকুর্দার, তার বাবার কাগজ কোথা থেকে পাব আমরা? অথচ সেটাই চাওয়া হচ্ছে। কখনও তুলে নিয়ে গিয়ে, কখনও এখানে এসে।’’ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রায়দিঘি থানা এলাকা থেকে এসেছিলেন ছবি বিবি। অল্পবয়সে স্বামীকে হারিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সংগ্রামের জীবন এঁরও। বলছেন, ‘‘আমরা বড়লোকদের বাথরুম সাফাই করে বেলা তিনটের সময় ফিরে পরিশ্রমের টাকায় খাই। আমাদের গ্রামে জমি নেই আর বাংলায় কথা বলি বলে কি আমরা বাংলাদেশি? দিল্লির বড় বড় নেতাদের চার পুরুষ আগের সব পরিচয়পত্র রয়েছে কি? কেন আমাদের মারতে মারতে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে?’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাংলায় এই কাজ করলে দিনে একশো টাকাও জোটে কি না সন্দেহ।’’ লক্ষ্মীর ভান্ডারের কথা তোলায় বললেন, ‘‘ওই হাজার টাকায় আমরা মাস চালাব, খাব, বাচ্চাদের লেখাপড়া করাব কী করে? যাদের মরদদের অন্য কাজ, জমি, পেশা রয়েছে, তাদেরচলতে পারে।’’

এই বস্তিতে খুব প্রকাশ্যেই চলছে মেরুকরণের খেলা। নাম গোপনের শর্তে এই বস্তির এক বাসিন্দা বলছেন, ‘‘হিন্দু ছেলেরা এসে আমাদের বলছে তোমরা বাড়ি ফিরে যাও, আমাদের কিছু হবে না, কিন্তু তোমাদের ধরবে। মুসলমানরা কি তবে নাগরিক নয়? তাই যদি হবে তা হলে কেন আমাদের এত ঘটা করে আধার কার্ড, প্যান কার্ড করানো হল? কেন আমাদের ভোট নেওয়া হল? ভোট মিটে গিয়েছে এখন বলছে ভাগো বাঙালি?’’

বিষয়টি স্পষ্ট হল এই বস্তি থেকে দু’কিলোমিটার দূরে আই ব্লকে গিয়ে। সেখানে বাঙালি বস্তিতে বিরাজ করছে অপার শান্তি। যা আজকের এই পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা ব্যতিক্রম তো বটেই। ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন বস্তির মুখে একটি হাড় জিরজিরে সেলুনের মালিক সুনীল শর্মা। তাঁর কথায়, ‘‘মুসলমানরা সব ছেড়ে চলে গিয়েছে। আর কোনও গোলমাল নেই। পুলিশ এসে যাচাই করে দেখে নিয়েছে বেশির ভাগেরই আধার কার্ড, ভোটার কার্ড আর প্যানের নাম আলাদা, বানান আলাদা!’’ পত্রকার এসেছে শুনে ঝটিতি চলে এলেন এই গোটা বস্তি এবং সংলগ্ন এলাকার মলিক দীপক ঠাকরান। এই বিপুল সম্পত্তি (আগে ছিল চাষের জমি) তিনি পেয়েছেন বাপ-ঠাকুর্দার সূত্রে। তিনি এবং ওই সেলুনের মালিক একই সুরে ‘বাঙালি’ এবং ‘মুসলমান’ দু’টিকে পৃথক শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করলেন। বক্তব্য, ‘‘এখানে শুধু বাঙালিরা (হিন্দু) আছেন এখন, তাই শান্তি রয়েছে। আর দশ-বারো ঘর মুসলমান রয়েছেন, তাঁরা বহু পুরনো বাসিন্দা, কাগজপত্র আমরা সব পরীক্ষা করে পুলিশকে জানিয়ে রেখেছি। ফলে সমস্যা নেই। তবে আশপাশের সব মুসলমান ভয়ে এলাকা ছাড়ছেন এটা ঠিক।’’

যে বস্তিতে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য, সেখানকার ছবিটা এমন নিস্তরঙ্গ নয় আর গুরুগ্রামে।

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Muslims Bengali Language Gurugram Religion Discrimination

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy