বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজদের আনাগোনা এখানে খুবই প্রচলিত ব্যাপার। কেননা, চিত্তরঞ্জন পার্ক তথা দিল্লির বাঙালিদের অন্যতম এই গড়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে গত চার দশকের রংটা মোটের উপর গেরুয়াই।
সেই চিত্তরঞ্জন পার্ক কালীবাড়ি সোসাইটির পরিচালন সমিতির সাম্প্রতিক নির্বাচনে গেরুয়ার মৌরসীপাট্টাই বহালই থাকল। এলাকার কংগ্রেস সমর্থক বাঙালিদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের ৩১ বছরের রাজ্যপাট এ বারেও ধরে রাখলেন বিজেপি-র প্রাক্তন কাউন্সিলর চিকিৎসক আনন্দ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু এ বার প্রবাসের এই কালীমন্দিরকে ঘিরে কংগ্রেস এবং বিজেপি-র যে ছায়াযুদ্ধ দেখা গেল তা কিছুটা অভূতপূর্বও বটে।
দীর্ঘকাল ধরে প্রাক্তন বিজেপি কাউন্সিলর আনন্দ মুখোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন থাকার ফলে সমিতির বিরুদ্ধে অনেকেরই বিভিন্ন কারণে ক্ষোভ জমছিল। সেই ক্ষোভকে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করে গিয়েছে স্থানীয় কংগ্রেস। এই পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বাঙালি মহল্লায় কান পাতলেই শোনা যায় তা হল, এখানে ঢুকতে হলে তাকে বিজেপি করতেই হবে! এ বারে ভোটের আগে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বর্তমান সমিতির দুর্নীতির অভিযোগও।
বিরোধী নেতারা বলছেন, গত লোকসভা নির্বাচনের পরে মন্দির কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সাংসদ শ্রীমতি মীনাক্ষি লেখি ও পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়কে সংবর্ধনা জানান। কিন্তু, মন্দিরের ৪০ বছরের ইতিহাসে দু-তিন জন ছাড়া কখনও কংগ্রেসের কোনও নেতা এখানে আমন্ত্রিত হননি। এমনকী, দীর্ঘ দিনের স্থানীয় কংগ্রেস সাংসদ অজয় মাকেন বা স্থানীয় কাউন্সিলর বীরেন্দ্র কাসানাকেও মন্দির কর্তৃপক্ষ কখনওই কোনও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেননি। স্থানীয় এক কংগ্রেস নেতার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কথায় একরাশ ক্ষোভ ঝরে পড়ল। বললেন, ‘‘মন্দিরের এক এক জন হর্তাকর্তার বাড়িতে কুড়ি-পঁচিশটা করে সদস্যপদ। ঝি-চাকর কেউ বাদ নেই। ভোটের দিন ভোটদাতা সদস্যদের কোনও পরিচয়পত্র দেখাতে হয় না। তাই ওরা ভুয়ো ভোটার নিয়ে আসে বাইরে থেকে। এই নির্বাচন আসলে গণতন্ত্রের শ্রাদ্ধ!’’
বক্তব্য রাখছেন আনন্দ মুখোপাধ্যায়।
এ বছর নির্বাচনের আগে সম্পাদক পদের বিরোধী প্রার্থী রাখালচন্দ্র চৌধুরীর বিলি করা একটি লিফলেট এখানকার বাঙালিদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। লিফলেট-এ পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে মন্দিরের ছয় লক্ষ টাকা তছরুপের অভিযোগ আনা হয়। বলা হয় যে পরিচালন সমিতির সভা না ডেকে সভাপতি ও সম্পাদক-সহ মাত্র ছ’জন সদস্য এই টাকা কোথায় ব্যয় করেছেন, তার কোনও সদুত্তর পরিচালন সমিতি হিসাব পরীক্ষককে দিতে পারেনি। এই অভিযোগের উত্তরে সদ্যপ্রাক্তন সম্পাদক শান্তি মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। ২০১৪-র অগস্টে টাকাটা আমাদের এক কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর তার পরিবারকে সাহায্য হিসেবে দেওয়া হয়। এ কথা ঠিক যে সময় কম থাকায় আমরা পরিচালন সমিতির পূর্ণাঙ্গ সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নিইনি, কিন্তু পরবর্তী সভাতে কোনও সদস্যই এ নিয়ে কোন কথা বলেননি। এত দিন পরে ভোটের সময় আমাদের ভাবমূর্তি খারাপ করতেই এই অপপ্রচার।"
এত বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ফর্মুলা কী? সত্তরোর্ধ আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথায়: ‘‘স্রেফ মানুষের ভালবাসা ও ভরসা আর আমদের পরিচালনায় শেষ হওয়া উন্নয়নমূলক কাজের খতিয়ান। গত বছর আমরা ৪০ লক্ষ টাকা খরচ করে একটা মিউজিক্যাল ফাউন্টেন বানিয়েছি। তাই বাঙালি-সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ সন্ধ্যেবেলা এখানে বেড়াতে আসেন।’’ আগামী পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি বললেন, ‘‘আমার বয়স হয়েছে। তাই তিনটি কাজ খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে চাই। প্রথমত মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দ্রুত শেষ করব। আর কালীবাড়ির অডিটোরিয়ামের আসন সংখ্যা খুব কম। তাই ৪০০ আসনের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড অডিটোরিয়াম তৈরি করতে হবে। গ্রন্থাগারের সম্প্রসারণটাও খুব জরুরি।’’
এটা ঘটনা যে দিল্লিতে আরও ৩-৪টি কালীবাড়ি থাকলেও বাঙালিদের কাছে নানা কারণে চিত্তরঞ্জন পার্কের এই কালীবাড়িটি বিশেষ পছন্দের। ১৯৭৪ সালে একটি এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমিতে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই কালীবাড়ির শুরু। তার পর ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে কালীমন্দির, রাধাকৃষ্ণ মন্দির, গ্রন্থাগার, অডিটোরিয়াম, যাত্রী নিবাস ইত্যাদি। এখানে প্রতি বছরই দুর্গাপূজা, কালীপূজা, শিবরাত্রি, রথযাত্রা ইত্যাদি খুব ধুমধাম করেই পালন করা হয়। তা ছাড়া নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠান, বইমেলা, কীর্তনের আসর, পুষ্প প্রদর্শনী ইত্যাদি নানা কিছু এখানে চলতেই থাকে। সারা দেশের বাঙালিদের ভিড়ে এখানকার যাত্রী নিবাসে জায়গা পাওয়াও খুব কঠিন।
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, সম্ভবত এই সামগ্রিক কারণে কংগ্রেস দশকের পর দশক মরিয়া থেকেছে পরিচালন কমিটির দখল পেতে। যদিও তা আগামী ২০১৭ পর্যন্ত (বর্তমান সমিতির মেয়াদকাল) অধরাই থাকতে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy