এ যেন আক্ষরিক অর্থেই শিয়রে সমন!
সম্প্রতি দেশের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস)। সেই মানচিত্রে কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পুরো অঞ্চলকেই ভূমিকম্পপ্রবণতার নিরিখে ‘জ়োন-৬’-এ ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ, অতি প্রবল মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে এই এলাকায়। এই ‘জ়োন’-এর মধ্যে দার্জিলিং-সহ পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় ও তরাইয়ের জেলাগুলিও আছে। আছে প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমের সব এলাকা এবং বিহারের উত্তরাঞ্চল। ভূতত্ত্ববিদেরা জানান, লে-লাদাখ বাদে দেশের মানচিত্রের পুরো মাথাই অতি ভূকম্পপ্রবণ এলাকায় পড়েছে। আন্দামান-নিকোবরও ভূমিকম্পের আশঙ্কার সর্বোচ্চ স্তরে আছে।
ভূমিকম্পের মানচিত্রে খুব স্বস্তিতে নেই পশ্চিমবঙ্গ। নয়া মানচিত্র অনুযায়ী, গৌড়বঙ্গ (মালদহ এবং দুই দিনাজপুর) এবং মুর্শিদাবাদ, নদিয়া-সহ মধ্যবঙ্গ পড়়েছে ‘জ়োন-৫’-এ। কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বাকি এলাকা ‘জ়োন-৪’-এর অন্তর্গত হয়েছে। খড়্গপুর আইআইটি-র ভূতত্ত্বের অধ্যাপক এবং বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শঙ্করকুমার নাথ বলছেন, ‘‘আগের মানচিত্রে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের কিছুটা জ়োন-৩ এবং কিছুটা জ়োন-৪-এর মধ্যে ছিল। নতুন মানচিত্রে পুরোটাই জ়োন-৪ হয়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা (খড়্গপুর আইআইটির ভূবিজ্ঞানীরা) যে দিশা দিয়েছিলাম তার অনেকটাই মান্যতা পেয়েছে।’’
হিমালয় পার্বত্য এলাকা যে ভূমিকম্পপ্রবণ, তা নতুন কথা নয়। বস্তুত, ভারতীয় পাত (ইন্ডিয়ান প্লেট) এবং ইউরেশীয় পাতের (ইউরেশিয়ান প্লেট) সংঘর্ষের ফলেই হিমালয় পর্বতের সৃষ্টি। ভূতত্ত্ববিদেরা জানান, ভারতীয় পাত বছরে একটি নির্দিষ্ট হারে ইউরেশীয় পাতের তলায় ঢুকছে। প্রতি বছর ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যে ভূমিকম্প হয় তার পিছনে এই দুই পাতের সংঘাতই মূল কারণ। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, অসম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিও মাঝেমধ্যেই ভূকম্প অনুভব করে।এই দুই পাতের সংঘাতের কথা মাথায় রেখেই একাধিক বার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মানচিত্র তৈরি হয়েছে। অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথ জানান, এর আগে যে মানচিত্র ছিল তাতে সর্বোচ্চ ‘জ়োন-৫’ রাখা হয়েছিল। কিন্তু যে হারে ভূমিকম্প হচ্ছে তার পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন মানচিত্র ‘জ়োন-৬’ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই পাত সংঘাত ছাড়াও উপমহাদেশের ভূস্তরের গঠনে চ্যুতি (ভূতত্ত্বের ভাষায় ফল্ট) আছে। এর মধ্যে একটি প্রধান চ্যুতিরেখা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা হয়ে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত। যার নাম ‘ইয়োসিন হিঞ্জ’। অধ্যাপক নাথ বলছেন, ‘‘এই চ্যুতিরেখার ফলেই কলকাতায় জোরালো ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে। এ ছাড়াও, মেদিনীপুর-ফরাক্কা ফল্টলাইনও আছে। ভূতাত্ত্বিক গড়ন অনুযায়ী বর্ধমানেও জোরালো ভূমিকম্প হতে পারে।’’
বাংলা-বিহারে প্রবল ভূমিকম্পের ইতিহাসও আছে। ১৮৮৫ সালে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে সিলেট ভূমিকম্পেও ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল। ১৯৩৪ সালে ভারত-নেপাল ভূমিকম্পে বিহারের পূর্ণিয়া-সহ নেপালের কাঠমান্ডু, পাটন-সহ বিভিন্ন এলাকায় ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। অনেকেই বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং লাগোয়া এলাকায় ওই মাপের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়নি। ২০১১ সালে সিকিম এবং ২০১৫ সালের নেপালের ভূমিকম্পেও মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই সব তথ্য সামনে রেখেই ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্প ঠেকানোর কোনও হাতিয়ার মানুষের কাছে নেই। তবে আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে নগর এবং বহুতলের নকশা-নির্মাণ করা যেতে পারে। তাতে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)