কাঞ্চীপুরমে ঢোকার আগে উড়ালপুল থেকেই দেখা যায় সুউচ্চ মন্দিরের চূড়া। লোকে বলে, এ শহরে হাজারখানেক মন্দির আছে। তার মধ্যে কামাক্ষী আম্মান, বরদরাজ পেরুমল আর একমবরেশ্বরের উচ্চতাই সবচেয়ে বেশি। তবে এই মন্দির নগরে এখনকার গন্তব্য কালেক্টরেট অফিস চত্বর, সেখান থেকে খুঁজে নিতে হবে একটি লাল রঙের বাড়ি। কাঞ্চীপুরম মহিলা পুলিশ থানা।
জুন মাসে এই কাঞ্চীপুরম মহিলা থানাই উঠে এসেছিল খবরে, এক নাবালিকা গণধর্ষণ মামলার সূত্রে। অষ্টম শ্রেণির দু’জন, নবম শ্রেণির একজন। তিন জন মিলে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর কাছে পড়া বোঝার নাম করে বন্ধুত্ব পাতায়। তার পর একদিন তাকে একটা ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে গিয়ে মদ মেশানো পানীয় খাইয়ে গণধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। জুন মাসে কালাক্কাত্তুর এলাকার ঘটনা। প্রথমে খবর গিয়েছিল চাইল্ড লাইনের কাছে। সেখান থেকে তদন্তের দায়িত্ব আসে কাঞ্চীপুরম মহিলা থানায়। ৯ জুন ঘটনাটা ঘটে, ১১ জুন অষ্টম শ্রেণির দুই ছাত্র গ্রেফতার হয়ে যায়। তৃতীয় জন পলাতক।
সামনের চেয়ারে হালকা পেস্তা রঙের অতি সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরনে, টান করে বিনুনি বাঁধা যে ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী বসে আছেন, তিনি ইনস্পেক্টর বিজয়লক্ষ্মী। কালাক্কাত্তুরের তদন্ত সামলেছেন নিজের কাঁধে। বললেন, কাঞ্চীপুরম মহিলা থানা রাজ্যের অন্যতম ব্যস্ত থানা। এই মহকুমার দশটি থানা এলাকা এই মহিলা থানার আওতায়। ১৯৯২ সালে চেন্নাইয়ের থাউজ়্যান্ড লাইট থেকে রাজ্যে মহিলা থানার যে যাত্রা শুরু, তার দু’বছর পর তৈরি হয় কাঞ্চীপুরম মহিলা থানা। বর্তমান ঠিকানায় সেটা উঠে আসে ২০০৪ সালে। একজন ইনস্পেক্টর, তিন জন সাব ইনস্পেক্টর, তিন জন হেড কনস্টেবল এবং দশ জন কনস্টেবল রয়েছেন। দৈনিক গড়ে প্রায় পাঁচটি করে অভিযোগ এখানে নথিভুক্ত হয়। তামিলনাড়ুতে এখন মোট ২৪৪টি মহিলা থানা। রাজ্যওয়াড়ি ভিত্তিতে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ।
কিন্তু মহিলাদের প্রতি হিংসা তাতে কমানো গেল কি? আন্না বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইটি মাদ্রাজে দুই ছাত্রীর যৌন হয়রানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিস্তর শোরগোল হয়েছে তামিলনাড়ুতে। বিরোধী দল এডিএমকে, বিজেপি থেকে শুরু করে নতুন দল খোলা থালাপতি বিজয়— সকলেই অভিযোগ করেছেন, তামিলনাড়ুতে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহের ঘটনা লাফিয়ে বাড়ছে। মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে তামিলনাড়ু তথা দক্ষিণী রাজ্যগুলির যতটা সুনাম এক কালে ছিল, তা আর যেন ততটা নেই। এ বছর ২৮ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন স্বরাষ্ট্র দফতরের জন্য তৈরি একটি পলিসি নোট বিধানসভায় পেশ করেন। যাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালে শুধু পকসো আইনের আওতায় নথিভুক্ত ধর্ষণ মামলাই তামিলনাড়ুতে ৫৩১৯টি। সংখ্যাটা ২০২৩-এ ছিল ৩৪০৭, ২০২২-এ ৩৬২০।
এই ‘উত্থান’কে কি শুধু নথিভুক্তি বৃদ্ধির নিরিখে ব্যাখ্যা করা যায়? যেমনটি করছে শাসক দল, যেমনটি করছেন তামিলনাড়ুর ডিজিপি? জনসচেতনতা শুধু নথিভুক্তিই বাড়াচ্ছে? অপরাধ কমাচ্ছে না? চেন্নাইয়ের অদূরে আভাড়ি কমিশনারেটের অফিসে বসে কথা হচ্ছিল সিনিয়র মহিলা আইপিএস-এর সঙ্গে। তিনি বললেন,‘‘সচেতনতা বৃদ্ধির জায়গাটায় আমরা সত্যিই খুব জোর দিচ্ছি। মহিলা থানা বাড়ার ফলে মেয়েরা অনেক বেশি করে অভিযোগ জানাতে ভরসা পাচ্ছেন। নিয়মিত স্কুল-কলেজে প্রচার চালানো হচ্ছে। তামিলনাড়ু পুলিশ মেয়েদের সুরক্ষার জন্য যে অ্যাপ চালু করেছে, শুধু আভাড়ি কমিশনারেট এলাকাতেই এখন তার ৬৫ হাজার গ্রাহক।’’উত্তর ভারতের চেয়ে দক্ষিণের অবস্থা এখনও ঢের ভাল বলে তাঁর দাবি। কারণ হিসাবে মনে করালেন, তামিলনাড়ু ই ভি রামস্বামী পেরিয়ারের মতো একজন সমাজ সংস্কারক পেয়েছিল। মেয়েদের ব্যাপারে অত্যন্ত প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা ছিল তাঁর। সেই মতাদর্শকে একেবারে অস্বীকার করা কোনও দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা মেয়েদের অধিকার এবং সুরক্ষার দিকটাকে গুরুত্ব দিতে অনেকাংশে বাধ্য। ঠিক যেমন তামিলনাড়ু পুলিশে মহিলা বাহিনী গড়ে তোলা এবং সরকারি চাকরিতে মহিলাদের ৩০ শতাংশ সংরক্ষণের কৃতিত্ব করুণানিধির। রাজ্যে মহিলা থানা গড়ে তোলার কান্ডারি জয়ললিতা। মহিলা থানাকে প্রতিটি মহকুমায় বিস্তার করার লক্ষ্যমাত্রা স্ট্যালিনের।
অন্য দিকে, নারী আন্দোলন কর্মী, বিশিষ্ট লেখক ভি গীতা ধরিয়ে দিলেন, ‘‘মহিলা থানা মানেই যে সমস্যার সমাধান, তা কিন্তু নয়। মহিলা হলেই সংবেদনশীল হবেন, মহিলা হলেই ক্ষমতার অপব্যবহার কম হবে— এমনও নয়।’’ প্রমাণ হাতে হাতে। এই এপ্রিল মাসেই ত্রিচির ডিআইজি ওই জেলার একটি মহিলা থানার অফিসারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অভিযোগ, ওই অফিসার একটি ধর্ষণ মামলায় ঠিক মতো অভিযোগ নেননি এবং ধর্ষিতার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। বালিকা ধর্ষণ মামলার তদন্তে গড়িমসি এবং অভিযুক্তকে আড়াল করার দায়ে এ বছরের জানুয়ারি মাসে গ্রেফতার হতে হয়েছে খোদ চেন্নাইয়ের আন্না নগর মহিলা থানার ইনস্পেক্টরকে। বছর দুয়েক আগে মাদ্রাজ হাই কোর্টও মহিলা থানার ভূমিকা সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিল, এই থানাগুলো লজ্জাহীন ক্যাঙারু কোর্টে পরিণত হয়েছে। যাদের সমাজকে সংবেদনশীল করে তোলার কথা ছিল, তারা নিজেরাই লিঙ্গচেতনাসম্পর্কে অজ্ঞ।
এই অজ্ঞতা দূর হবে কী ভাবে? অশোকনগর পুলিশ ট্রেনিং অ্যাকাডেমির তিন তলায় এ রাজ্যের মহিলাদের প্রতি অপরাধ দমনের বিশেষ উইং-এর কার্যালয়। সেখানকার শীর্ষ সূত্রে জানা গেল, মহিলা থানাগুলিকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে পুলিশ এবং প্রশাসনের অন্দরেও সচেতনতা প্রসারের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ বছরের শুরুতে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইনে বদল এসেছে। সেখানে হয়রানির সংজ্ঞার পরিধি বেড়েছে, শাস্তি কঠোরতর হয়েছে এবং সেই সঙ্গে অভিযোগকারিণীর সুরক্ষার বন্দোবস্তও বেড়েছে। রাজ্যের সমাজকল্যাণ এবং নারী স্বশক্তিকরণ মন্ত্রী গীতা জীবনও দাবি করছেন, নারী সুরক্ষায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের দিক থেকে তামিলনাড়ু পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপের গুরুত্ব অস্বীকার করছেন না আইনজীবী বিএস অজিতা। কিন্তু তাঁর খেদ, খাতায়কলমে হচ্ছে অনেক কিছুই। মেয়েদের শিক্ষার হার, মেয়েদের জীবিকার হারের নিরিখে নিঃসন্দেহে তামিলনাড়ু অনেক কদম এগিয়ে। কিন্তু যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানমনস্কতার যে মনোভঙ্গি, তার পাশাপাশি তৈরি হওয়া দরকার ছিল, সেটা হয়নি। যারফলে পুলিশে, প্রশাসনে, বিচারবিভাগে মেয়েদের লক্ষণীয় উপস্থিতি সত্ত্বেও পিতৃতন্ত্রের শিকড় আলগা হয়নি।শুধু আলগা হয়নি নয়, উল্টে গত দশ বছরে আরও গভীর হয়েছে। জাতপাত, ধর্মের বেড়ি কঠোরতর হচ্ছে। বাল্যবিবাহ, মর্যাদার নামে খুনখারাপি বাড়ছে— ধর্ষণ এবং যৌন নিগ্রহের বাড়বাড়ন্তকে এই চালচিত্র থেকে আলাদা করা যায় না। ভি গীতা এর সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘জয়ললিতার আমল থেকে তামিলনাড়ুতে গণতান্ত্রিকতার একটা বড়অবক্ষয় হয়েছে, সেটা এখনও সবটা কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এর ফলে জো-হুজুরি মানসিকতা জাঁকিয়ে বসেছে, সামাজিক যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের পরিবেশ কমে গিয়েছে।’’
শুধু প্রশাসনিকতা দিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধ ঠেকানো যায় কি?
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)