Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দু’বছর ভারতের জেলে কাটিয়ে ফিরলেন ওঁরা

স্বভূমে রওনা হওয়ার আগে অর্চনা বিশ্বাস বলে গেলেন, ফের ভারতে আসবেন। তবে আর অবৈধ উপায়ে নয়। পাসপোর্ট-ভিসা নিয়েই সীমান্ত পেরোবেন। দু’বছর আগে চোরাপথে করিমগঞ্জে প্রবেশ করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন বাংলাদেশের জকিগঞ্জের এই মহিলা। সঙ্গে ছিল তাঁর দুই শিশুপুত্র, গোপাল ও গোবিন্দ।

করিমগঞ্জ সীমান্তে গোবিন্দ-গোপাল। কুশিয়ারা নদীর সীমান্ত পেরিয়ে জকিগঞ্জের ঘরে ফিরবে তারা। বৃহস্পতিবার সকালে। ছবি: শীর্ষেন্দু সী।

করিমগঞ্জ সীমান্তে গোবিন্দ-গোপাল। কুশিয়ারা নদীর সীমান্ত পেরিয়ে জকিগঞ্জের ঘরে ফিরবে তারা। বৃহস্পতিবার সকালে। ছবি: শীর্ষেন্দু সী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
করিমগঞ্জ ও শিলচর শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২৯
Share: Save:

স্বভূমে রওনা হওয়ার আগে অর্চনা বিশ্বাস বলে গেলেন, ফের ভারতে আসবেন। তবে আর অবৈধ উপায়ে নয়। পাসপোর্ট-ভিসা নিয়েই সীমান্ত পেরোবেন।

দু’বছর আগে চোরাপথে করিমগঞ্জে প্রবেশ করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন বাংলাদেশের জকিগঞ্জের এই মহিলা। সঙ্গে ছিল তাঁর দুই শিশুপুত্র, গোপাল ও গোবিন্দ। আর ছিল সম্পর্কিত দেওর বাসুদেব রায়। অনুপ্রবেশের সাজা কাটার পরেও জেলই ছিল তাঁদের ঠিকানা। গোপাল-গোবিন্দের শৈশবের দু’টি বছর কেটেছে এই জেলেই। আজ সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হল। মোট ১০ জন বাংলাদেশিকে এই কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা হয় এদিন। অন্য ছ’জন হলেন বুরহানুদ্দিন, শামিম আহমদ, আনোয়ার হোসেন, সাবলু আহমদ, এনামুদ্দিন ও আলি হোসেন। এঁরাও ভারতে এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। তবে দু’ বছরের বেশি সময় ভারতের জেলে কাটিয়ে আর তাঁদের অর্চনার মতো আর সীমান্ত পেরিয়ে এদিকে আসার ইচ্ছে নেই। বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে তাঁরা আর কখনও ভারতমুখো হবেন না। এমনকী ভাল কাজের সুযোগ পেলেও নয়, বললেন এনামুদ্দিন। অন্য পাঁচ জনেরও একই কথা।

ব্যতিক্রম অর্চনাদেবী। খোলামেলা বললেন, ‘‘ফের আসব। পাকাপাকি থাকার জন্য ভারতে আসব।’’ তাঁর কথায়, ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে করিমগঞ্জে কাকার বাড়ি এসেছিলেন তিনি। মূল লক্ষ্য ছিল, একটু জমিজমা কিনে রাখা। সঙ্গে বেশ কিছু টাকাও এনেছিলেন। সে টাকাও করিমগঞ্জে রয়ে গিয়েছে। টাকা ফেরত নিতে কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আবার আসতে চান। বাংলাদেশে থাকা আর সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন অর্চনাদেবী।

কিন্তু পাসপোর্ট নিয়ে এলেই বাংলাদেশিদের এখানে থাকতে দেওয়া হবে? গোপাল-গোবিন্দকে জড়িয়ে ধরে পুলিশ ভ্যানে উঠতে উঠতে বললেন, এটা তো হিন্দুস্তান। এখন আইন হচ্ছে, যে কোনও দেশের হিন্দুরা এখানে আশ্রয় নিতে পারবে। পরে নাগরিকত্ব পাবেন। কোনও জড়তা নেই অর্চনাদেবীর। বললেন, ‘‘বাড়িতে স্বামী আছেন। স-মিলে কাজ করেন। আমাদের এক মেয়েও রয়েছে। সবাই মিলে ভারতে শরণার্থী হব। পরে জায়গা-জমি কিনে এখানেই থাকব।’’

আজ সকাল ছ’টায় শিলচর সেন্ট্রাল জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এইচ সি কলিতা ১০ বাংলাদেশিকে করিমগঞ্জ পুলিশের হাতে তুলে দেন। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপের সাক্ষী হতে কাছাড়ের জেলাশাসক এস বিশ্বনাথনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে দুই দেশের চার জেলার জেলাশাসক, পুলিশ সুপারদের বৈঠক হয়। সেখানে তিনি শিলচরে বন্দি ৫৪ বাংলাদেশির তালিকা তুলে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই দশ জনের ঠিকানা নিশ্চিত করে ফেরানো হল। তিনি আশাবাদী, অন্যদেরও পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশি বন্দির সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এঁদের ফেরত পাঠানোর পর আরও ৬৩ জন এই সময়ে শিলচর জেলে (ডিটেনশন ক্যাম্পে) আটক রয়েছেন। দুই দেশের পরবর্তী বৈঠকে নতুন তালিকা পেশ করা হবে বলে জানান জেলাশাসক।

আজ প্রথম দফায় যাঁরা ছাড়া পেয়েছেন, তাঁদের হস্তান্তর করতে করতে বেলা সাড়ে ১০টা বেজে যায়। শিলচর থেকে করিমগঞ্জ থানা হয়ে পরে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় কালীবাড়ি ঘাট পাসপোর্ট চেকপোস্টে। সেখানে কাগজপত্র ঠিকঠাক করার পর অসমের সীমান্ত শাখার পুলিশ এবং বিএসএফ জওয়ানরা দশ জনকেই নদীপথে বাংলাদেশে নিয়ে যান। কুশিয়ারা নদীর ওপারে, জকিগঞ্জে গিয়ে বিজিবি-র হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁদের।

এতদিন অবৈধ ভাবে ভারতে প্রবেশ করা নাগরিকদের কারাবাসের মেয়াদ ফুরনোর পর ‘পুশব্যাক’ করা হতো। বাংলাদেশ সরকার তাতে আপত্তি করলে তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। পরে শুরু হয় জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার পর্যায়ের আলোচনা।

করিমগঞ্জের পুলিশ সুপার প্রদীপরঞ্জন কর আজ বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর সময় নিজে উপস্থিত ছিলেন। গোপাল-গোবিন্দের হাতে তুলে দেন বড় চকলেটের প্যাকেট। অর্চনাদেবী জানান, পুজোর আগে জেলে গিয়ে এক সংস্থা তাঁদের নতুন জামা-কাপড় দিয়েছে। সেই শাড়ি-জামা পরেই আজ বাড়ি যাচ্ছেন তাঁরা।

এ দিকে, শিলচর সেন্ট্রাল জেলে আজ দিনভর গোপাল-গোবিন্দর অনুপস্থিতিই চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যাবজ্জীবন কারাবন্দি ফজলুদ্দিন বড়ভুইয়া, মতীন্দ্র শুক্লবৈদ্য বললেন, ‘‘ছেলেগুলি মামা-মামা বলে ডাকত। বলতে গেলে, আড়াই বছর কোলে-পিঠে করে আমরাই বড় করে তুলেছি। বড় ফাঁকা লাগছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladeshi Citizen Prison
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE