চলতি মাসে একাধিক রাজ্যে অভিযান, ধরপাকড়ের পরে খুব বেশি হলে দেড়শোর কাছাকাছি সশস্ত্র মাওবাদী ‘রেড করিডরে’ সক্রিয় রয়েছেন বলে মনে করছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের আশা, আগামী মার্চের আগেই তাঁদের হত্যা বা গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। মাওবাদী নেতা মাড়বী হিড়মার মৃত্যুর পর শীর্ষ স্তরে, লড়াইয়ে দক্ষ তিন জন নেতাই এখন সক্রিয়।
নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে এত দিন মূল চিন্তা ছিল, মাড়বী হিড়মার উপস্থিতি। কেন্দ্রীয় কমিটির জনজাতি সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি হিড়মার আদর্শগত স্বচ্ছতার অভাব থাকলেও যোদ্ধা হিসেবে জুড়ি ছিল না। পুলিশি ধরপাকড়, একাধিক সেন্ট্রাল কমিটি সদস্যের মৃত্যু এবং আত্মসমর্পণ সত্ত্বেও সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন পিপ্লস লিবারেশন গেরিলা আর্মির ১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের প্রধান হিড়মা। কিন্তু হিড়মা এবং আইইডি বানানোয় বিশেষজ্ঞ টেক শঙ্করের মৃত্যুতে মাওবাদীদের মধ্যে ভাঙন এখন সময়ের অপেক্ষা বলেই মনেকরা হচ্ছে।
গোয়েন্দাদের মতে— বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির যে সদস্যরা রয়ে গিয়েছেন, তাঁরা হলেন মুপ্পালা লক্ষ্মণ রাও ওরফে গণপতি, পি হনুমানথু ওরফে গণেশ, পি নরহরি ওরফে বিশ্বনাথ, এম দেব ওরফে রামদার, মিসির বেসরা, অনল দা, মাজ্জিদেব। বর্তমানে সংগঠনের সশস্ত্রআন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন থিপরি তিরুপতি বা দেবজি। যিনি কট্টরপন্থী নেতা বলে পরিচিত। অন্য জন পিএলজিএ প্রধান বি দেবা। বর্তমানে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে রয়েছেন তিনিই। তাঁর সঙ্গে ৩০ জনের মতো মাওবাদী ক্যাডার রয়েছে বলেই গোয়েন্দাসূত্রের খবর।
মাওবাদীদের এখন সবথেকে বড় সমস্যা প্রশিক্ষিত ক্যাডারের অভাব। অর্থ জোগানের উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় নতুন অস্ত্র কিনতেও সমস্যা হচ্ছে। পুলিশি নজরদারি চলায় নতুন ক্যাডার আসাও প্রায় বন্ধ। ফলে সশস্ত্র মাওবাদীর সংখ্যা কমতে কমতে এখন সাকুল্যে ১৫০-২০০য় এসে দাঁড়িয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের মতে, অতীতে শুধু দেবার নেতৃত্বেই তিনশো জনের দল ছিল। তাঁদের অধিকাংশ মারা গিয়েছেন বা গ্রেফতার হয়েছেন বা আত্মসমর্পণ করেছেন। গোয়েন্দা সূত্রের মতে, একটি বিষয় স্পষ্ট যে মাওবাদীদের কোনও ভাবে রেয়াত করা হবে না। তাই আগামী দিনে বড় সংখ্যায় মাওবাদীরা আত্মসমর্পণ করতে চলেছেন। বিশেষ করে তিরুপতি ও দেবার মৃত্যু হলে পাঁচ দশকব্যাপী মাওবাদী সশস্ত্র আন্দোলনে ইতি পড়বে বলে আশাবাদী কেন্দ্র।
ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুর, সুকমা ও নারায়ণপুর— এই তিনটি জেলাতেই বর্তমানে সেই অর্থে মাওবাদীদের প্রভাব রয়ে গিয়েছে। স্বরাষ্ট্র কর্তাদের দাবি, আগে মোবাইলে এনক্রিপটেড পদ্ধতি ব্যবহার করে মাওবাদীরা যোগাযোগ রাখতেন। কিন্তু প্রযুক্তিবিদেরা সেই এনক্রিপশন ভেঙে ফেলায় একাধিক মাওবাদী ধরা পড়েন বা পুলিশের গেরিলা অভিযানে মারা যান। তাই এখন স্বল্প দূরত্বের ওয়াকিটকি ব্যবহার করছেন তাঁরা। কিন্তু সেই বার্তার উপরেও নজর রাখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নিচু তলার ক্যাডারের মাধ্যমে পায়ে হেঁটে বা সাইকেল-বাইকে হাতে লেখা বার্তা বা পেন ড্রাইভের সাহায্যে বার্তা চালাচালি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক কর্তার কথায়, ‘‘সেই বার্তাবাহকদেরও চিহ্নিত করে নজর রাখা হচ্ছে।’’ কখনও বার্তাবাহকদের দলে টেনে এনে ভুল বা বিভ্রান্তিকর বার্তা পাঠিয়ে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে মাওবাদীদের।
সূত্রের মতে, এ বছরে প্রথমে নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজের মৃত্যু এবং গত মাসে বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতির আত্মসমর্পণেই স্পষ্ট হয়ে যায় মাওবাদীদের মধ্যে আড়াআড়ি বিভাজন হয়ে গিয়েছে। বাসবরাজের মৃত্যুর পরে ভূপতি সংগঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। কিন্তু মানুষের সমর্থন কমে যাওয়া, সংগঠনে বেনো জলের কারণে আত্মসমর্পণের পক্ষেই সওয়াল করেন তিনি। আত্মসমর্পণ করেন পুল্লরি প্রসাদ রাও, তেলঙ্গনা রাজ্য কমিটির সদস্য বান্দি প্রকাশ ওরফে প্রভাতও। কিন্তু আত্মসমর্পণে আপত্তি ছিল হিড়মাদের মতো দক্ষ লড়াকুদের। তাঁরা সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যান। কিন্তু হিড়মার মৃত্যুর পরে ফের ভাঙনের মুখে মাওবাদীরা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)