প্রধান বিচারপতিরা অবসরের দিন প্রেস লাউঞ্জে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নাও এলেন। হাসি মুখে গল্প করতে করতেই জানিয়ে দিলেন, ‘‘অবসরের পরে কোনও সরকারি পদ গ্রহণ করব না।’’ প্রধান বিচারপতি পদে মাত্র ছয় মাসের ইনিংস। ২০২৪-এর ১১ নভেম্বর থেকে ২০২৫-এর ১৩ মে। কোনও মাইলফলক তৈরির চেষ্টা নয়। প্রচারের আলোর পিছনে ছোটা নয়। শনি-রবিবার নিয়ম করে কোনও আলোচনাসভায় গিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা নয়। বিদায়বেলায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বললেন, মুখ বুজেই সংবিধান রক্ষা করার ‘নিঃশব্দ উত্তরাধিকার’ রেখে গেলেন প্রধান বিচারপতি খন্না। দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার মন্ত্রকে যতখানি সম্ভব আগলে রাখলেন। ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দিলেন। বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ধরে রাখার চেষ্টা করলেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলে থাকেন, বিচারপতিরা আদালতের বাইরে অনেক লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিতে পারেন। তাঁরমেরুদণ্ড চেনা যায় আদালতে এজলাসে। বিশেষ করে সেই সব মামলায়, যেখানে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়। সংবিধান রক্ষা করার অগ্নিপরীক্ষা সামনে হাজির হয়।
প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরেই সঞ্জীব খন্নার সামনে এই রকম মামলা হাজির হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংশোধন করে ১৯৭৬ সালে ভারত সম্পর্কে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ ঢোকানো হয়েছিল। তাকে চ্যালেঞ্জকরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল। আদালতের বাইরেই গেরুয়া শিবিরের প্রচার ছিল, মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার সময় এই শব্দ ঢুকিয়েছিলেন।
প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে সঞ্জীব খন্না স্রেফ ছক্কা হাঁকানোর মতো এই মামলা মাঠের বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁর রায় ছিল, সংবিধানের মূল প্রস্তাবনাতেই ধর্মনিরপেক্ষতার মন্ত্র প্রতিধ্বনিত হয়। আর সমাজতন্ত্র কল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিভাজনের বেলুন চুপসে গিয়েছিল।
একই ভাবে শীর্ষ আদালতে মন্দির-মসজিদ বিবাদও প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের মাত্র তিন পৃষ্ঠার রায়ে এক ঝটকায় থেমে গিয়েছিল। প্রধান বিচারপতি পদে সঞ্জীব খন্নার পূর্বসূরী ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষার অনুমতিতে বাধা দেননি। তার পরে যখন সম্ভলের জামা মসজিদ থেকে অজমেঢ় শরিফের দরগার নীচে মন্দির রয়েছে বলে দাবি উঠেছিল, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের আর্জি শুনেই বিভিন্ন আদালত মসজিদে সমীক্ষার অনুমতি দিতে শুরু করেছিল। মন্দির-মসজিদের চরিত্র রক্ষায় তৈরি উপাসনাস্থল আইনকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা দায়ের হয় তখন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সঞ্জীব খন্না হস্তক্ষেপ করেন। রায় দেন, কোনও আদালত মসজিদে সমীক্ষা চালানোর নির্দেশ দিতে পারবে না। এ নিয়ে কোনও মামলাও করা যাবে না।
প্রবীণ আইনজীবী রাজু রামচন্দ্রন আজ তাঁর বিদায় সম্বর্ধনায় বলেছেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি খন্না দেখিয়ে গেলেন, মুখের কথায় নয়, রায়ের মাধ্যমেই বিচারপতিরা নিজেদের প্রমাণ করেন।’’
সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী আইন পাশ করানোর পরে মোদী সরকার প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চেই কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। আইনে স্থগিতাদেশ জারি হতে পারে আঁচ করে সরকার নিজেই আইনের বিতর্কিত ধারার প্রয়োগ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
অবসরের মাত্র এক মাস আগে এই অবস্থানের পরে অবশ্যম্ভাবী ছিল তাঁর আজকের ‘অবসরের পরে সরকারি পদ গ্রহণ করব না’ বলে ঘোষণা। প্রয়াত অরুণ জেটলি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, বিচারপতিদের অবসরের পরে সরকারি পদ গ্রহণ তাঁদের অবসরের আগে রায়কে প্রভাবিত করে। মোদী সরকারের জমানায় এক প্রধান বিচারপতি রাজ্যসভার সদস্যও হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না তাঁর পূর্বসূরীদের পথে হাঁটলেন না।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অবশ্যই প্রধান বিচারপতি হিসেবে সঞ্জীব খন্নাকে মনে রাখবে, নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় ২৬ হাজার চাকরিখারিজের মামলার রায়ের জন্য। তবে ছয় মাসের ইনিংসে তাঁর আরও একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল, দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি যশবন্ত বর্মার থেকে বস্তা ভর্তি নগদ টাকা উদ্ধার।
আমজনতার মনে প্রশ্ন উঠেছিল, বিচারপতিরা ঘুষ নিয়ে রায় দেন? প্রধান বিচারপতি হিসেবে সঞ্জীব খন্নার সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল, আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো। রাখঢাক না করে তিনি প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করে দেন। আদালতের অভ্যন্তরীণ তদন্তের রিপোর্ট তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইঙ্গিত মিলেছে, বিচারপতি বর্মাকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে। মঙ্গলবারই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল।আজ সুপ্রিম কোর্টের প্রেস লাউঞ্জে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এ বিষয়ে বলছিলেন, ‘‘আমরা ভাল-মন্দ দেখে যুক্তিপূর্ণ ভাবে বিচার করি। তার পর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ভবিষ্যৎ বলে সেটা ঠিক ছিল না ভুল।’’
জরুরি অবস্থার সময়ে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারও স্থগিত থাকে কি না, এ নিয়ে এডিএম জবলপুর মামলা রায়ে সে সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হংসরাজ খন্না ভিন্ন মত জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তার জেরে তাঁর প্রধান বিচারপতি পদও হাতছাড়া হয়। আজ তাঁর ভাইপো সঞ্জীব খন্নার প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরের দিনে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা শেষ কথা বললেন: ‘‘বিচারপতি হংসরাজ খন্না আজ আপনাকে নিয়ে গর্বিত হতেন।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)