Advertisement
০২ মে ২০২৪
ধাক্কা দিল্লির

চিনের চোখে পাকিস্তান সন্ত্রাসের শিকার

ব্রিকস সম্মেলন শেষ হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানের সমর্থনে সরাসরি নেমে পড়ল চিন।

ব্রিকসে শি চিনফিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী। ছবি: এএফপি।

ব্রিকসে শি চিনফিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:১১
Share: Save:

ব্রিকস সম্মেলন শেষ হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানের সমর্থনে সরাসরি নেমে পড়ল চিন।

নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের জন্মদাত্রী হিসেবে তুলে ধরলেও বেজিং আজ সরকারি ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা সে কথা বলতে রাজি নয়। চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনইংয়ের মন্তব্য, ‘‘সন্ত্রাসবাদকে কোনও একটা বিশেষ দেশ, ধর্ম বা জাতির সঙ্গে জুড়ে দেখতে চায় না বেজিং। সবাই জানে, ভারত আর পাকিস্তান— দু’টো দেশই সন্ত্রাসের শিকার। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে পাকিস্তান অনেক পদক্ষেপ করছে, অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে তাদের।’’ পাকিস্তানের এই ভূমিকাকে ‘আন্তর্জাতিক মহলের সম্মান জানানো উচিত’ বলেই মন্তব্য করেছেন তিনি।

সন্ত্রাস প্রশ্নে পাকিস্তানকে একঘরে করার কৌশল নিয়েছে নয়াদিল্লি। সেই সময়ে ইসলামাবাদ সম্পর্কে বেজিংয়ের এই ব্যাখ্যা মোদী সরকারের সামনে বড় কূটনৈতিক ধাক্কা। এর আগে কখনও মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার প্রস্তাব আটকে দিয়েছে চিন। কখনও পরমাণু জ্বালানি সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে দিল্লির ঢোকার পথে বাধা তৈরি করেছে। তার পরেও গত কাল নানা ভাবে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং বুঝিয়ে দেন যে, সন্ত্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তানকে আলাদা ভাবে কোণঠাসা করায় তাঁদের সায় নেই। ব্রিকসের মঞ্চ থেকে তিনি ভারতের উদ্দেশে মন্তব্য করেন, ‘‘সন্ত্রাস দমনের জন্য এর শিকড় কোথায় তা খুঁজে বের করতে হবে।’’ মোদীর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, এই কথা বলে আসলে কাশ্মীরের কথাই সুকৌশলে উত্থাপন করেছে বেজিং।

আজও চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মন্তব্য করেছেন, ‘‘চিনের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান। চিন মনে করে, দু’দেশই আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির সমাধান করবে এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করবে।’’ কূটনীতিবিদদের একাংশের মতে, চিনের এই বক্তব্যের সুরটা হল— ‘দুই দেশ অনেক ঝগড়া করেছ, এ বার মিটমাট করে নাও।’ কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভাষ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে ‘হাইফেন’টি অনেক কষ্টে সরানো গিয়েছিল, চিনের এই প্রতিক্রিয়ায় সেটিকে আবার ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দিয়েছে ভারত। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাকে ব্রিকসের মতো বহুপাক্ষিক মঞ্চে টেনে নিয়ে এসে মোদী সেমসাইড গোল দিয়ে ফেলেছেন।

চিনা সরকার অবশ্য নিজে থেকে এই বিষয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি। নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের জননী হিসেবে তুলে ধরায় এ দিন বেজিংয়ে সাংবাদিকেরা চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন। সেই প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সন্ত্রাস প্রশ্নে যে ভাবে প্রকাশ্যে ইসলামাবাদের হয়ে সওয়াল করছে চিন, তা নিয়ে কূটনীতিকদের মনে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন ব্যাখ্যা উঠে আসছে এ নিয়ে। অনেকেই মনে করছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বেজিংয়ের আর্থিক ও ভূ-কৌশলগত স্বার্থ জড়িয়ে থাকায় সব সময়েই তারা ইসলামাবাদকে সমর্থন করে থাকে। কিন্তু পাঁচ দেশের ব্রিকস সম্মেলনে ভারতের তরফ থেকে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ায় ইসলামাবাদকে সমর্থনের প্রশ্নে আরও এক কদম এগোল চিন।

বেজিংয়ের এই অবস্থানের পরেও বিদেশ মন্ত্রকের অনেক কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, পাকিস্তান এবং চিন— এই দুই দেশের সঙ্গে একযোগে সংঘাতে যাওয়া মোটেই ঠিক নয়। বরং পাকিস্তানের সঙ্গে এই যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে চিনের উদ্দেশে বন্ধুত্বের বার্তা দেওয়াটা বিশেষ জরুরি ছিল। মস্কোকে ‘পুরনো বন্ধু’ বলে চিন সম্পর্কে কঠোর মনোভাব নেওয়ার ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক কূটনীতিক। চিন যে সার্কের দেশগুলির সঙ্গে অতি-সক্রিয় কূটনীতি শুরু করেছে, সেটা নিয়েও ভারতীয় কূটনীতিকদের কোনও সন্দেহ নেই। এ সবই তাঁদের কাছে উদ্বেগের বিষয়।

তবে বিদেশ মন্ত্রক সূত্র বলছে, চিনের এই অবস্থান দেখে মোদী সরকার রণকৌশল পরিবর্তনের কথাও ভাবছে। মোদী মনে করছেন, চিন এবং পাকিস্তান— দু’টি দেশকেই এক পর্যায়ের শত্রু করাটা ঠিক নয়। কার্গিল যুদ্ধের সময় প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ বলেছিলেন, ভারতের প্রধান শত্রু পাকিস্তান নয়, চিন। সেই মন্তব্য নিয়ে দেশের নানা মহলে, এমনকী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভাতেও ঝড় উঠেছিল। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রের বক্তব্য ছিল, চিন এবং পাকিস্তানকে একসঙ্গে শত্রু বানানো ঠিক নয়। উল্টে তিনি চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিতর্ক মেটাতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখন একই কৌশলে ফেরার কথা ভাবছে কেন্দ্র। চিনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি বিতর্কের জায়গাগুলি গোপন না করে আলোচনার পথেই এগোবে দিল্লি।

এর পাশাপাশি, নেপাল যে ভাবে চিন এবং ভারতকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে, তা নিয়েও চিন বিশেষজ্ঞ ভারতীয় কূটনীতিকদের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। যদিও বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপের মতে, এই তিন রাষ্ট্রনেতার বৈঠক কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল বা প্রচণ্ডের ছেলে প্রকাশও এই বৈঠককে ‘কাকতালীয়’ বলেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

china india pakistan modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE